ঝুলন্ত তার সরাতে নানা পদক্ষেপ, অগ্রগতি কোথায়?
রাজধানীতে তারের জঞ্জাল দিন দিন যেন বাড়ছেই। অলি-গলি কিংবা রাজপথে বিদ্যুতের খুঁটিতে ঝুলে আছে অসংখ্য তার। বিদ্যুতের লাইনের পাশাপাশি স্যাটেলাইট টিভির ক্যাবল, ইন্টারনেট ও টেলিফোনের তার যত্রতত্র বয়ে গেছে। এতে রাজধানীর সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে, ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা।
ঝুলন্ত তার অপসারণের মাধ্যমে শহরের সৌন্দর্য ফেরাতে দুই সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষ বারবার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে ঝুলন্ত তার মাটির নিচে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ। কিছু কিছু এলাকায় স্বল্প কাজ হলেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীবাসী অনেকেই বলছেন, ঝুলন্ত তারের কারণে নগরের অন্যান্য সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ ম্লান হয়ে যায়। এক টুকরো খোলা আকাশও দেখার উপায় নেই। পাশাপাশি তারা ভয়ে থাকেন, না জানি কখন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে যায়। নগরের এ সমস্যা নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী তৌহিদুল ইসলামের। তিনি বলেন, এই শহরে মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে, সড়কে চলছে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ, সড়কের ডিভাইডারে লাগানো হচ্ছে ফুলের গাছ। কিন্তু মাথা তুলে উপরের দিকে তাকালে সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। সর্বত্র তারের ছড়াছড়ি।
তারের জঞ্জাল সরাতে গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ এবং ১ অক্টোবর থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তার কাটার অভিযান শুরু করে। প্রতিবাদে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও কেবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) তাদের সেবা বন্ধের ঘোষণা দেয়। পরে কর্মসূচি স্থগিত করে গত বছরের ১৮ অক্টোবর মেয়র তাপসের সঙ্গে বৈঠক করেন সংগঠনের নেতারা। বৈঠকে ওই বছরের নভেম্বরের মধ্যেই ঝুলন্ত তার অপসারণের প্রতিশ্রুতি দেন তারা। এরপর ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও ঝুলন্ত তার অপসারণ করে মাটির নিচে নিতে পারেনি আইএসপিএবি ও কোয়াব।
শহরের অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে সম্প্রসারিত বিভিন্ন সেবা সংস্থার ঝুলন্ত তারের কারণে প্রায়ই বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটছে। বিদ্যুতের তার থেকে অন্যান্য তার বিদ্যুতায়িত হতে পারে। যাতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি ঘটতে পারে অগ্নি দুর্ঘটনা। কিংবা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকার বাড্ডার এক বাসিন্দা নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৃষ্টি হলে বিদ্যুতের তারের থেকে ইন্টারনেট, টেলিফোন কিংবা ডিস লাইন বিদ্যুতায়িত হতে পারে। নানা সময় আমরা দেখি বিদ্যুতের তার থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সবসময় ভয়ে থাকি।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এম এ হাকিম এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, তার অপসারণে এনটিটিএনের সঙ্গে আমাদের কাজ চলছে। আমরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বেশ কিছু কাজ করেছি। এর মধ্যে উত্তরা জোনে আমাদের উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। সেই তুলনায় আমার দক্ষিণ সিটি এলাকায় তেমন কাজ করতে পারিনি।
তিনি বলেন, ঢাকা সিটিতে যে ভবনগুলো রয়েছে, সেগুলো আনপ্ল্যানড ওয়েতে এগিয়েছে, যেখানে পুরোটা জুড়েই তারের জঞ্জাল। বর্তমানে ছয়টি এনটিটিএন অপারেটর রয়েছে, যেগুলো ১২ বছর ধরে কাজ করছে। তারাই এখনো তারের জঞ্জাল সরানোর কাজ শেষ করতে পারেনি। তাহলে আমরা এক বছরে কতটুকু কাজ করতে পারব? আমাদেরও সময় দিতে হবে এই তারের জঞ্জাল সরাতে। এটি খুব সহজ কাজ নয়।
আইএসপিএবি সভাপতি এম এ হাকিম আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতিসহ নানা কারণে আমরা উল্লেখযোগ্যভাবে তার অপসারণের কাজ গত এক বছরে খুব বেশি করতে পারিনি। ঢাকা মেট্রো সিটিতে পরিপূর্ণভাবে তারের জঞ্জাল সরাতে আরও বেশ কয়েক বছর সময় দরকার। তবে আশার কথা, আমরা এক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারাতেও তার অপসারণের বেশ কিছু কাজ করতে পেরেছি। এছাড়া ধানমন্ডি এলাকায় তার অপসারণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ের দিকে।
এদিকে শহরের সৌন্দর্য ফেরাতে তারের জঞ্জাল বিষয়ে কঠোর অবস্থান দেখিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন, কিন্তু মাঝপথে এসে দুই করপোরেশনের কার্যক্রমেরও ভাটা পড়ে গেছে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারের জঞ্জাল সরাতে আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। তার অপসারণের জন্য ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) এবং ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (কোয়াব) সময় দিয়েছি। নির্দিষ্ট সময়ের পর আমরা তাদের ক্যাবল কেটে দেওয়ার অভিযানও পরিচালনা করেছি। কিন্তু তাদের কাজ এত দ্রুত করা সম্ভব না, যে কারণে তাদের আরও কিছুটা সময় দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তাদের কাজগুলো করে ফেলতে হবে, নইলে আমরা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেব।
জানা গেছে, গত এক দশক ধরে তারের জঞ্জাল সরানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও বেশকিছু এলাকায় এরইমধ্যে বিদ্যুতের তার মাটির নিচ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় তার সরিয়ে মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ঢাকায় বিদ্যুতের খুঁটি থেকে তারের জঞ্জাল সরাতে চীনের অর্থায়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)।
তারের জঞ্জাল সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন সময় কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করা এসব তারের জঞ্জাল অপসারণে আমরা বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়ে এসেছি। সিটি করপোরেশন বিভিন্ন কেবল অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পর তাদের সময় দিয়েছে, সে সময়ও পেরিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তিনি বলেন, জানি এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এসব তারের সঙ্গে জড়িতরা পেশিশক্তির মানুষ, তাই হয়তো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। এরপরও শহরের সব নাগরিক চান, তারের জঞ্জাল সরিয়ে শহরের মূল সৌন্দর্য ফিরেয়ে আনা হোক। অলি-গলি, পাড়া-মহল্লাসহ প্রধান সড়কে আমরা আর এসব তারের জঞ্জাল দেখতে চাই না।
এএসএস/আরএইচ//