জলবায়ুর বিপর্যয় থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে...
১২ বিলিয়ন ডলারের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছে বাংলাদেশ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে ১২ বিলিয়ন ডলারের ১০টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছে বাংলাদেশ। এছাড়া তিনি জলবায়ুর ভয়াবহ বিপর্যয় মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের কথাও তুলে ধরেছেন কমনওয়েলথ এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামে (সিভিএফ)।
সোমবার (১ নভেম্বর) বিকেলে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) মূল পর্ব লিডার সামিটে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ করে দরিদ্রতম ৪৮টি দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বে কার্বন নিঃসরণে এসব দেশের অবদান মাত্র শতকরা ৫ ভাগ। তিনি দেশগুলোর অর্থায়ন চাহিদার আশু স্বীকৃতি দাবি করেছেন ধনী দেশগুলোর কাছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে একটি বাস্তব সম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান খুঁজে বের করারও তাগিদ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
সোমবার স্থানীয় সময় সকালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনের সাইডলাইনে ‘ক্লাইমেট প্রসপারিটি পার্টনারশিপ’ বিষয়ে সিভিএফ-কমনওয়েলথ উচ্চপর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সংগঠন সিভিএফ-এর সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন বৈশ্বিক এবং আন্তঃসীমান্ত সমস্যা। কোনো দেশই এর ভয়াল পরিণাম থেকে সুরক্ষিত নয়।
তিনি বলেন, ক্রমাগত জলবায়ু বিপর্যয় বাড়ছে এবং সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অপরিবর্তনীয় ক্ষতির শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বৈশ্বিক খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার কমিটির (আইপিসিসি) প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আইপিসিসি প্রতিবেদনটি পরিষ্কার সতর্কবার্তা দিয়েছে, আমাদের পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে জরুরি এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
আইপিসিসির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে মানবসভ্যতা চূড়ান্ত বিপদের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। আর এজন্য মানুষই পুরোপুরি দায়ী। আগামী দুই দশকের মধ্যেই পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফল হিসেবে এই শতকের শেষে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতার বৃদ্ধির জন্য ভয়ানক পরিণতির মুখে পড়বে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলগুলো।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে জলবায়ুতে যেসব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, যা আর ঠেকানো যাবে না। প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড মানবজাতির জন্য ‘রেড অ্যালার্ট’।
দায় কম হলেও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সদস্য ৪৮টি দেশ বিশ্বের মোট পরিমাণের মাত্র ৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য মৌলিক হুমকি সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শক্তিশালী সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জলবায়ু সংকট নিয়ে সোচ্চার শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তিশালী, সাহসী এবং সংবেদনশীল কাজের জন্য কার্যকর সহযোগিতা ও সমন্বয়ের তাৎপর্য প্রমাণ করেছে।
জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের দুর্বলতা এবং প্রয়োজনীয়তাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে তাদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করা দরকার।
তিনি বলেন, প্রায়ই বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের প্রথম শিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দুর্বলতা এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দৃষ্টান্ত মূলক উদ্যোগ নিয়েছি।
কম কার্বন নিঃসরণের পথ অনুসরণ করে ‘জলবায়ু দুর্বলতাগুলোকে’ ‘জলবায়ু সমৃদ্ধিতে’ রূপান্তর করতে বাংলাদেশের ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
সিভিএফ এবং কমনওয়েলথের একসঙ্গে কাজ করার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতি এবং অবদানের ক্ষেত্রে কমনওয়েলথ দেশগুলোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
সিভিএফের এক-তৃতীয়াংশ দেশ কমনওয়েলয়েরও সদস্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ এক সঙ্গে কাজ করতে পারে। সিভিএফ এবং কমনওয়েলথের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার জন্য ছয়টি সুপারিশ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রথম সুপারিশে শেখ হাসিনা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ এবং প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান অর্জনে জ্ঞান, গবেষণা, সক্ষমতা তৈরি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
দ্বিতীয় সুপারিশে প্রধানমন্ত্রী প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সবাইকে সম্মিলিত অবস্থান নিতে বলেন। এক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত অবস্থান জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তৃতীয় সুপারিশে জলবায়ু অভিবাসী ইস্যুতে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তিনি বলেন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, নদী ভাঙন, বন্যা এবং খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে জলবায়ু অভিবাসীরা তাদের পৈত্রিক ভিটেমাটি, ঐতিহ্যগত পেশা হারাচ্ছে। এ মানুষগুলোর পুনর্বাসনে বৈশ্বিক দায়িত্ব রয়েছে।
চতুর্থ সুপারিশে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সবার ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ- প্রধান গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী দেশগুলোকে তাদের উচ্চাভিলাষী এবং অ্যাগ্রেসিভ এনডিসিএস ঘোষণা করাতে একটি চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে।
পঞ্চম সুপারিশে শেখ হাসিনা জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সহনীয় খরচে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন টেকনোলজি হস্তান্তর করার কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড।
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৬) যোগ দিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে রোববার (৩১ নভেম্বর) স্থানীয় সময় বিকেলে গ্লাসগোতে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। এর আগে বাংলাদেশ সময় রোববার সকালে ঢাকা থেকে রওনা হন তিনি।
গ্লাসগোতে অবস্থানকালে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সোচ্চার ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কপ-২৬ সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্ব এবং রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের বক্তব্যের সেশন ছাড়াও সাইডলাইনে অনেকগুলো ইভেন্টে অংশ নেবেন। পাশাপাশি শেখ হাসিনা বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং বিভিন্ন সংস্থা প্রধানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
গ্লাসগোতে অবস্থানের দিনগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যায়ক্রমে কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটসের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিয়ন, ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর স্কট মরিসন, স্কটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার অ্যালিসন জনস্টোনের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
গ্লাসগো সফর শেষে বুধবার দুপুরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে লন্ডন যাবেন প্রধানমন্ত্রী। লন্ডনে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ শেষে ৯ নভেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে দ্বিপাক্ষিক সফরে প্যারিস যাবেন তিনি।
প্যারিস সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী জিন ক্যাটেক্সের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন। এছাড়া ফ্রান্স সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কো সদর দফতরে ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর দ্য ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ বিতরণ অনুষ্ঠান এবং ইউনেস্কোর ৭৫তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। আগামী ১৪ নভেম্বর দেশে ফেরার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
এসআর/এসএসএইচ