ডিজে কামরুলের ড্যান্স ক্লাব থেকে শতাধিক তরুণী পাচার
সিনেমা জগতে পার্শ্ব নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেতে চান কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল। পাশাপাশি ঢাকায় ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে টার্গেট করেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণীদের। নাচ শেখানোর আড়ালে তাদের ফাঁদে ফেলে পাচার করেন ভারতে। শুধুমাত্র ডিজে কামরুল চক্রের খপ্পড়ে পড়েই গত দুই-তিন বছরে শতাধিক তরুণী পাচারের শিকার হয়েছেন।
অন্যদিকে, আরেকটি পাচারচক্র মধ্যপ্রাচ্যে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাচার করে। চক্রটি গত পাঁচ বছরে অন্তত ৩৫ জন নারীকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পাচার করেছে। বৈধভাবে আরও প্রায় ২৫০ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে গেলেও কথা অনুযায়ী তাদের কাজ দেওয়া দেয়নি চক্রটি, উল্টো তাদের বিক্রি করে দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার রাতে চক্র দুটির ১১ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। একইসঙ্গে উদ্ধার করেছে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা ও তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২২ জন এবং চুয়াডাঙ্গার জীবনগর থেকে পাচার হওয়ার ঠিক আগমূহূর্তে ১ জনসহ মোট ২৩ নারীকে।
মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও চুয়াডাঙ্গা থেকে ভারতে তরুণী পাচার করা চক্রের মূলহোতা কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল (৩৭) এবং তার চক্রের সদস্য রিপন মোল্লা (২২), আসাদুজ্জামান সেলিম (৪০) ও নাইমুর রহমান ওরফে শামীমকে (২৫) গ্রেফতার করেছে র্যাব।
বনানী, পল্লবী, তেজগাঁও ও উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয় মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচার করা চক্রের মূলহোতা মো. নুর-নবী ভুইয়া রানা (৪৪) এবং তার চক্রের সদস্য আবুল বাশার (৫২), আল ইমরান (৪১), মনিরুজ্জামান (৩৫), শহিদ সিকদার (৫৪), প্রমোদ চন্দ্র দাস (৬২) ও টোকনকে (৪৫)।
দুটি চক্রের কাছ থেকে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল ফোন, আট বোতল বিদেশি মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, দুটি মোটরসাইকেল, একটি ল্যাপটপ, এক সেট কম্পিউটার, ৯১ হাজার ৪০ টাকাসহ মানবপাচার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নথি জব্দ করে র্যাব।
চক্র দুটির সম্পর্কে জানাতে শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুরে র্যাব-৪ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গত মে মাসে পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের এক তরুণীর পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে র্যাব ওই চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে এক মা ভারতে পাচার হয়ে পাচারকারীদের কাছ থেকে মেয়েকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় কাল্লু-সোহাগ সিন্ডিকেটের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব।
পাচারের শিকার কয়েকজন ভুক্তভোগী সম্প্রতি র্যাবের কাছে অভিযোগ করে। অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব ছায়াতদন্ত শুরু এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এর অংশ হিসেবেই ২৩ ভুক্তভোগীকে উদ্ধার এবং ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানান তিনি।
র্যাবের এ কর্মকর্তা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে বলেন, ভারতে নারী পাচারকারী চক্রের মূলহোতা ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল। এ চক্রে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য রয়েছেন। দুই-তিন বছর আগে থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে পাচারের সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে প্রথমে কামরুলের চক্রটি নাচ শেখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণীদের ঢাকায় নিয়ে আসে এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করিয়ে তাদের বেপরোয়া জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করে।
পরে পার্শ্ববর্তী দেশে আরও উন্নত জীবন-যাপনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের পাচার করে। ভুক্তভোগীদের প্রথমে সীমান্ত এলাকায় সেফ হাউজে রাখা হয়। এরপর সিন্ডিকেটের যোগসাজশে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে ওপারে পাচার করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কখনো কখনো বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার নামে তরুণীদের গ্রুপ নিয়ে ভারতে যান কামরুল। সেখানে নিয়ে ফাঁদে ফেলে তাদের বিক্রি করে দেন। গত দুই থেকে তিন বছরে সবমিলিয়ে শতাধিক তরুণীকে ভারতে পাচার করে কামরুল চক্র। সেখানে মূলত অমানবিক ও অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করা হয়।
অপর চক্রটি চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করে দেয়। এই চক্রে রয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন সক্রিয় সদস্য। গত পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে চক্রটি পাচারের সঙ্গে জড়িত। চক্রের সদস্যরা তরুণী ও মধ্যবয়সী নারীদের হাউজকিপিং, নার্স, রেস্টুরেন্ট কর্মী হিসেবে বিনা পয়সায় মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর প্রলোভন দেখান।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মূলত ভুক্তভোগীদের বিদেশে বিক্রি করে দেয় চক্রটি। এ পর্যন্ত চক্রটি ৩০ থেকে ৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। এছাড়া, বৈধভাবে আরো ২০০ থেকে ২৫০ জন নারীকে বিদেশে নিয়ে গেছে চক্রটি। তাদের যে কাজ দেওয়ার কথা বলে নেওয়ায় হয়, তা দেওয়া হয় না। উল্টো তাদের বিক্রি করে দেয় চক্রটি। কখনো কখনো তাদের আটকে রেখে স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে।
তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচার করা চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার নুর-নবী ভুইয়া রানার নেতৃত্বে ঢাকায় কয়েকটি সেফ হাউজ পরিচালিত হয়। সেসব হাউজে ভুক্তভোগীদের আটকে রেখে পরে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়। প্রথমে তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার আর্থিকভাবে অসচ্ছল তরুণী ও মধ্যবয়সী নারীদের টার্গেট করে। পরে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সেফ হাউজে নিয়ে ভুয়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এ সময় কেউ বিদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তাদের কাছ থেকে দেড়-দুই লাখ টাকা আদায় করা হয়।
নুর-নবী ভুইয়া রানা ১৯৯৮ সাল থেকে বিদেশে কাজ করেন। দুবাই ও ওমানে তিনি প্রবাসী হিসেবে কাজ করেছেন। ওমানে থাকা অবস্থায় মানবপাচারকারী একটি চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন থেকেই তিনি পাচার কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে যান।
ভারতে নারী পাচার করা চক্রের মূলহোতা ডিজে কামরুলের নামে বাড্ডা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা রয়েছে। এছাড়া অপর চক্রের সদস্য মনিরুজ্জামানের নামে সবুজবাগ থানায় বাংলাদেশ পাসপোর্ট আইনে, প্রমোদের নামে পল্টন থানায় প্রতারণার এবং টোকনের নামে যশোর জেলার অভয়নগর থানায় প্রতারণা ও জালিয়াতির একটি করে মামলা রয়েছে। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলে জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
জেইউ/আরএইচ