প্রতীকী ছবি

পারিবারিক জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে ঘর ছেড়েছিল রাজধানীর পল্লবীর তিন কলেজছাত্রী। উচ্চাকাঙ্ক্ষায় বিভোর তিন বান্ধবী কক্সবাজার হয়ে যেতে চেয়েছিল জাপানে। ঢাকায় ফেরার পর তাদের উদ্ধার করে এমনটি জানিয়েছিল র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। 

ওই তিন ছাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে ‘হাফসা চৌধুরী’র নাম। তাকে মানবপাচারকারী একটি চক্রের মূলহোতা হিসেবে সামনে নিয়ে আসে তারা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এই নারী একটি কাল্পনিক চরিত্র। এই নামের কারো অস্তিত্ব এখনো মেলেনি। হয়তো চক্রটি হাফসা নাম ব্যবহার করে পেছন থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

র‍্যাব-৪ এর কর্মকর্তারা বলছেন, আবদুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ থেকে তিন কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করলেও মানবপাচারকারী চক্রটির কোনো সদস্যকে আটক করা যায়নি। কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) এবং এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে হাফসা সম্পর্কে কোনো ধারণাই মেলেনি।

অন্যদিকে পল্লবী থানা পুলিশ বলছে, উদ্ধার হওয়া তিন ছাত্রী পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে না। দেখা করতে গেলে নারী পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। তাদের তদন্তেও হাফসা নামক চরিত্রের কোনো তথ্যই মিলছে না।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে পল্লবীর নিজ নিজ বাসা থেকে ওই তিন কলেজছাত্রী নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও নিজেদের শিক্ষা সনদ নিয়ে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছিল। পরে ২ অক্টোবর রাতে নিখোঁজ এক শিক্ষার্থীর বড় বোন বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন। যাতে চারজনকে আসামি করা হয়। ৬ অক্টোবর নিখোঁজ তিন কলেজ শিক্ষার্থীকে উদ্ধারের কথা জানায় র‌্যাব-৪।

উদ্ধারের পর র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ঘটনার অনুসন্ধান ও ভিকটিমদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিন বান্ধবী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া পড়াশোনা ও ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার জন্য পরিবারের চাপে বিরক্ত হয়ে পড়ে তারা।

পরিবারের নিয়ম-কানুন এবং সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম-কানুন তাদের কাছে অত্যাচার মনে হতো। তারা মূলত উচ্চবিলাসী জীবন-যাপন পছন্দ করত। দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি বিশেষ করে জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তারা অধিক পরিমাণে জাপানি সিনেমা-সিরিয়াল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে জাপানি ভাষা আয়ত্ত করে নেয়।

র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার্থীরা দাবি করে, তারা স্বাধীন জীবন-যাপন ও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করে। জাপানি সংস্কৃতিতে নারী পুরুষের সম-অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, দত্তক হওয়ার সুযোগ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ না থাকার বিষয়টি তাদের আকৃষ্ট করে।  

তিনি জানান, দুই মাস আগে তিন বান্ধবী তাদের বন্ধু তরিকুলের সঙ্গে দিয়াবাড়িতে ঘুরতে যায়। সেখানে হাফসা চৌধুরী নামে এক নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। ওই নারীর সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানায়। পরে তাদের ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয় এবং হাফসা চৌধুরী তাদের জাপান যেতে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। 

তিন বান্ধবী পরিকল্পনা মতো কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বাসা থেকে বেরিয়ে গাবতলী যায়। হাফসার পরামর্শে তারা নিজেদের ফোন নষ্ট করে ফেলে। এক পর্যায়ে হাফসার লোকজনের পরামর্শ অনুযায়ী তারা চট্টগ্রাম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। 

পরে বাসে করে কুমিল্লার ময়নামতি গিয়ে কেডস, পোশাক ও একটি ফোন কেনে। এরপর তারা চট্টগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে আরও দুটি ফোন কিনে কক্সবাজার চলে যায়। সেখানে একটি হোটেলে গিয়ে কয়েকদিন থেকে হাফসার লোকের কাছে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা হারিয়ে ঢাকায় ফেরে। ৬ অক্টোবর তারা ঢাকায় পৌঁছালে র‍্যাব ৪ এর একটি দল তাদের উদ্ধার করে।   

সেই হাফসা ও হাফসার মানবপাচার চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের বিষয়ে জানতে চাইলে র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের ছায়া তদন্তে হাফসার কোনো অস্তিত্ব আমরা পাইনি। আপাতত বলা যায়, মানবপাচারের ক্ষেত্রে হাফসা একটি কাল্পনিক চরিত্র। হয়তো এই নাম ব্যবহার করে পেছন থেকে মানবপাচারের চক্র পরিচালনা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, হাফসার কোনো ছবি, মোবাইল, সম্ভাব্য এনআইডি ও ঠিকানা আমরা পাইনি। যে কারণে এখন পর্যন্ত তাকেসহ কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কক্সবাজারে নোয়া গাড়িতে থাকা দুই ব্যক্তিকে শনাক্তে চেষ্টা চলছে।

র‌্যাবের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চক্রটি খুবই চতুর। চক্রের প্রত্যেক সদস্যই তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। ভিকটিমদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা একপাক্ষিক যোগাযোগ রাখে। ভিকটিমরা চাইলেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না। চক্রটি যখন চায়, তখন যোগাযোগ হয়। হাফসা নামের চরিত্রটিও একই কায়দায় ওই তিন শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ভিকটিমদের সঙ্গে তারা ট্রেসলেস একটা সম্পর্ক তৈরি করে। সরাসরি কোনো সিম ব্যবহার করে ভিকটিমদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না।

পল্লবীর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাফসা নামে আমরা কারো অস্তিত্ব তদন্তে এখনো পাইনি। হতে পারে এটি একটি কাল্পনিক নাম। হয়তো হাফসার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু ভিন্ন কোনো নামে সক্রিয়।

তিনি বলেন, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে চক্রটির হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ হয়েছিল। চতুর মানবপাচার চক্রের সদস্যরা তা সুকৌশলে ট্র্যাশ থেকেও ডিলিট করেছে। কোনো আইডির অস্তিত্বও তারা রাখেনি। চক্রটির সদস্যরা খুব বেশি এক্সপার্ট। তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ায় তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা করা সম্ভব হয়নি। ভুক্তভোগীরাও পুলিশকে কোনো তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে না। নারী পুলিশ সদস্যরা গেলে জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য দিচ্ছে না। উল্টো খারাপ আচরণ করছে। তবে থানা পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

জেইউ/আরএইচ