কয়লাভিত্তিক প্রকল্প হলে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার অন্যতম দূষণকারী দেশ
বাংলাদেশ সংশোধিত ইন্টেন্ডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (আইএনডিসি) জমা দিলেও সেখানে কার্বন হ্রাসের বাড়তি কোনো কার্যক্রম ও পরিকল্পনা প্রদান করা হয়নি।
দেশে প্রস্তাবিত ১০টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিলেও নতুন করে কয়লা প্রকল্প না করার ঘোষণা আসেনি। রামপাল, মাতারবাড়ি, বাঁশখালী প্রকল্পসহ মোট ১৯টি কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম কয়লা দূষণকারী দেশে রূপান্তরিত হবে, যা কার্বন নিঃসরণ কমানো সংক্রান্ত সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) ‘আসন্ন কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) অবস্থান ও সুপারিশপত্র’ প্রকাশের জন্য আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উঠে আসে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে ৩১ অক্টোবর ২০২১ যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে শুরু হতে যাচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬। সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে করণীয় বিষয়ে টিআইবির অবস্থান ও সুপারিশপত্র প্রকাশ উপলক্ষে টিআইবি কার্যালয় থেকে এ ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবাশ্ম জ্বালানি বৈশ্বিক মোট কার্বনের তিন-চতুর্থাংশ নিঃসরণ করে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ইউরোপের ৫০টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট-জিরো’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং সংশোধিত আইএনডিসি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও তারা ভারী শিল্পগুলো যেমন- পরিবহন, ইস্পাত ও ভারী শিল্পখাত থেকে অপর্যাপ্ত কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা দিয়েছে। তাদের দেওয়া সংশোধিত প্রতিশ্রুতি কার্বন হ্রাসে বৈশ্বিক মোট ঘাটতির মাত্র ২০ শতাংশ পুষিয়ে দিতে পারবে। সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতসহ প্রভাবশালী দেশগুলো দ্রুত সময়ে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হ্রাসের সরাসরি বিরোধিতা করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সংশোধিত আইএনডিসি জমা দিলেও সেখানে কার্বন হ্রাসের বাড়তি কোনো কার্যক্রম ও পরিকল্পনা দেয়নি। প্রস্তাবিত ১০টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিলেও নতুন কয়লা প্রকল্প গ্রহণ বন্ধের ঘোষণা সরকার দেয়নি। রামপাল, মাতারবাড়ি, বাঁশখালী প্রকল্পসহ মোট ১৯টি কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬৩ গুণ বাড়বে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ১১৫ মিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করবে। ফলে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম কয়লা দূষণকারী দেশে রূপান্তরিত হবে, যা কার্বন নিঃসরণ কমানো সংক্রান্ত সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
উদাহরণ হিসাবে গবেষণায় বলা হয়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পরিকল্পিত আটটি কয়লা প্রকল্প থেকে দূষণের ফলে ৩০ বছরে ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। শুধু জাপান সরকারের অর্থায়নে কক্সবাজারে মাতারবাড়িতে স্থাপিত কয়লা প্রকল্পের দূষণ ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার ও এর আশপাশের পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও এ খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো পথরেখা প্রণয়ন করা হয়নি। ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি থাকলেও বর্তমানে প্রতিদিন মাত্র ৭৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। যা মোট উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য জাতিসংঘের গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের (জিসিএফ) বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু অর্থায়নের প্রধান মাধ্যম জিসিএফ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য ১৯০টি প্রকল্পে ১০ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করে। যার মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে। এর মধ্যে অনুদান ৪২ শতাংশ এবং ঋণ ৪৪ শতাংশ। জিসিএফ কর্তৃক তহবিল প্রাপ্তিতে কঠিন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এ তহবিল থেকে সহায়তা পাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এ সুযোগকে আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজে লাগিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জিসিএফ নিবন্ধন নিচ্ছে এবং জিসিএফের দেওয়া অনুদানের সঙ্গে ঋণ যুক্ত করে এটিকে একটি লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করছে, যা অনৈতিক। আর বাংলাদেশের ছয়টি জিসিএফ প্রকল্পে ৩৬৮ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন দিলেও অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে, যা মোট বরাদ্দের ৭.৭৭ শতাংশ মাত্র। জিসিএফএর প্রকল্প তহবিল ছাড় এবং বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে জলবায়ু উপদ্রুত এলাকায় দুর্যোগ ক্ষয়-ক্ষতি বেড়ে চলেছে।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কপ সম্মেলন-২৬ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশের ফোরামের সভাপতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। সেই বিবেচনায় আমাদের অবস্থান আরও সুসংহত করার সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু ক্ষতিকারক দেশগুলো শক্তিশালী হওয়ার কারণে পিছিয়ে গেলে চলবে না। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
আরএম/এসএসএইচ