সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম। বর্তমানে বরিশালের সওজ অফিসে কর্মরত। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। হিসাব খোলা থেকে ২০২০ সালের ৫ জুলাই পর্যন্ত তিন বছরে চার কোটি ৯৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা জমা করার পর তা উত্তোলন করেন। এভাবে তার হিসাবে মোট নয় কোটি ৮৯ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।

অন্যদিকে, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নজরুল ইসলামের ভাই মো. তরিকুল ইসলামের নামেও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় আরও একটি হিসাব খোলা হয়। সেখানেও ২০২০ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত ছয় কোটি এক লাখ টাকার লেনদেন হয়।

একই প্রক্রিয়ায় নজরুল ইসলামের স্ত্রী (গৃহিণী) শাহনাজ পারভীনের হিসাবেও ৭৫ লাখ টাকার এফডিআরসহ আরও অর্থ লেনদেন হয়। এভাবে নজরুল ইসলামসহ তাদের ব্যাংক হিসাবে মোট ২১ কোটি এক লাখ টাকা লেনদেন হয়। এছাড়া বরিশাল সদরে নিজের নামে একটি বহুতল ভবন এবং বরিশাল সদরে ৮.৩৫ শতাংশ জমির তথ্য পাওয়া যায়।

নজরুল ইসলাম, তার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন ও ভাই মো. তরিকুল ইসলামের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের নামীয় হিসাবে বিভিন্ন সময়ে ২১ কোটি এক লাখ টাকা জমা ও উত্তোলনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই অর্থ বর্তমানে তার ব্যাংক হিসাবে জমা নেই। কিংবা লেনদেন করা অর্থের কোনো বৈধ উৎস জানা যায়নি

অবৈধভাবে অর্জিত ওই অর্থ বৈধ করতে স্ত্রী ও তার ভাইয়ের ব্যাংক হিসাবকে ব্যবহার করেন নজরুল ইসলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে মিলেছে এসব প্রমাণ। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকেও তাদের লেনদেনে অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সওজ’র ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে। চলতি বছরের মার্চ মাসে নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর ব্যাংকের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যসহ একটি প্রতিবেদন দুদকের হাতে আসে। এরপরই দুদক উপপরিচালক মাজেদুল ইসলাম ও উপপরিচালক এদিপ বিল্লাহর নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করা হয়।

ইতোমধ্যে কমিশনের অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। যতটুকু জানি কমিশন থেকে মামলার অনুমোদন হয়েছে। যেকোনো সময় মামলা করতে পারে দুদক— বলেন ওই কর্মকর্তা।

সড়ক ও জনপথ অধিদফতর / ফাইল ছবি

অভিযোগ অনুসন্ধানে চলতি বছর দুই দফায় নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়। কিন্তু তিনি হাজির হয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। বরিশাল থেকে ডাকযোগে লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধান টিমের প্রধান উপপরিচালক মাজেদুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। মামলার বিষয়ে জনসংযোগ দফতরে যোগাযোগ করতে বলেন।

নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

দুদক ও বিআইএফইউ’র প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, নজরুল ইসলাম ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন (হিসাব নং- ১১৩৭১২১২১৯৬০০০৮)। ২০২০ সালের ৫ জুলাই পর্যন্ত তিন বছরে সেখানে চার কোটি ৯৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা জমা হয়। এর মধ্যে তিনি চার কোটি ৯৪ লাখ নয় হাজার টাকা উত্তোলন করেন। হিসাবটিতে মোট নয় কোটি ৮৯ লাখ টাকা লেনদেন হয়।

অন্যদিকে, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নজরুল ইসলামের ভাই মো. তরিকুল ইসলামের নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় আরও একটি হিসাব (সঞ্চয়ী হিসাব নং- ১১৩৭১২১২৭২০০০১৩) খোলা হয়। সেখানেও ২০২০ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত ছয় কোটি এক লাখ টাকা লেনদেন হয়। এছাড়া নজরুল ইসলামের ওই একই ব্যাংকের বরিশাল শাখায় এফডিআর হিসাবে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয় / ফাইল ছবি 

নজরুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ পারভীনের নামে ২০১৯ সালের ৩০ মে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় এক বছর মেয়াদি ৭৫ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। যা ২০২০ সালের মে মাসে উত্তোলন করা হয়। এছাড়া ওই ব্যাংকে শাহনাজ পারভীনের নামে পাঁচটি এফডিআর ও এসবিডিএস হিসাব পাওয়া গেছে।

সূত্র আরও জানায়, বরিশালের পূবালী ব্যাংক শাখায় ২০১৮ সালে নজরুল ইসলাম আরও একটি হিসাব (সঞ্চয়ী হিসাব নং- ০৩৭৪১০১১৯৪৮৬৪) খোলেন। সেখানে ১০ লাখ টাকা জমা করে তার ভাইয়ের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। এছাড়া আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডে নজরুল ইসলামের নামে ছয়টি এফডিআর এবং ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৫ বছর মেয়াদি ৮৬ লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। যা তিনি পরিশোধ করে দেন।

বরিশাল সদরে তার নামে একটি বাড়ি রয়েছে এবং তার স্ত্রীর নামে বরিশাল সদরে ৮.৩৫ শতাংশ জমির তথ্য-প্রমাণ মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে।

এভাবে নজরুল ইসলাম, তার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন ও ভাই মো. তরিকুল ইসলামের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের নামীয় হিসাবে বিভিন্ন সময়ে ২১ কোটি এক লাখ টাকা জমা ও উত্তোলনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই অর্থ বর্তমানে তার ব্যাংক হিসাবে জমা নেই। কিংবা লেনদেন করা অর্থের কোনো বৈধ উৎস জানা যায়নি।

এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন- ২০১২ এর ৪ (২) ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় অভিযোগ আনা হচ্ছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

আরএম/এমএআর/