টাকা সব গ্রাহকের, প্লট-ফ্ল্যাট আর্থিক প্রতিষ্ঠান সব জসিমের
সমবায়ভিত্তিক দারিদ্র্য নিরসনের দায়িত্বে নিয়োজিত সমবায় অধিদফতরের অনুমোদন ছিল কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির। ২০১৯-২০ সালে সমবায় অধিদফতর অডিটও করে। অডিটে দেখানো হয়, মাত্র ৫১৮ জন সদস্য। লেনদেন মাত্র ৮২ লাখ টাকা।
#সমবায়ের হিসেবে সদস্য ৫১৮ লেনদেন ৮২ লাখ
বিজ্ঞাপন
#র্যাবের তথ্যে সদস্য ২০ থেকে ২৫ হাজার, লেনদেন শতকোটি টাকা
#নিবন্ধনভুক্ত হলেও লেনদেন, এনজিও বা সুদভিত্তিক লোন দেয়ার অনুমোদন নেই
# গ্রাহকের টাকায় পলাতক জসিম গড়েছেন প্লট-ফ্ল্যাট, জমি
#মানি লন্ডারিং মামলা হলে টাকা ফেরত পেতে পারে গ্রাহকরা
# মামলার প্রেক্ষিতে সমবায় অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে র্যাব
তবে র্যাব বলছে, প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। প্রতিষ্ঠানটিতে লেনদেন হয়েছে শত কোটি টাকার বেশি। যা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জসিম উদ্দিন ব্যক্তিগত একাউন্টে অর্থ ট্রান্সফার করে মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ করেছেন। গড়েছেন নামে-বেনামে প্লট-ফ্ল্যাট ও জমি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ গড়ে তুলেছেন আটটি প্রতিষ্ঠান।
র্যাবের দাবি, সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধনভুক্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কার্যক্রম প্রতারণামূলক। নিয়ম অনুযায়ী, সমিতি পরিচালনার অনুমোদন থাকলেও আর্থিক লেনদেন অনুমোদিত নয়। এছাড়া এনজিও এবং মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরির আর্থিক লেনদেনের অনুমোদনও নেই।
গত সোমবার (২৫ অক্টোবর) রাজধানীর পল্লবীতে প্রতিষ্ঠানটির সামনে বিক্ষোভ করে দুই শতাধিক বিনিয়োগকারী। পরে র্যাব-৪ সোমবার দুপুর থেকে মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত মিরপুর ১১/এ, রোড নং-৬, প্লট-৪, নান্নু সুপার মাকের্টে অভিযান চালিয়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. এর প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার অন্যরা হলেন, মো. চাঁন মিয়া (৩৮), এ কে আজাদ (৩৫), মো. রেজাউল (২২), তাজুল ইসলাম (৩১), শাহাবুদ্দিন খাঁন (২৮), আব্দুস ছাত্তার (৩৭), মাসুম বিল্লা (২৯), টিটু মিয়া (২৮) ও আতিকুর রহমান (২৮)।
অভিযানের সময় প্রতারণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে ১৭টি মুদারাবা সঞ্চয়ী হিসাব বই, ২৬টি চেক বই, ২টি ডিপোজিট বই, ৩টি সিল, ১২০টি ডিপিএস বই, একটি রেজিস্টার বই, একটি নোটবুক, একটি স্যালারি শিট, ৩০টি জীবন-বৃত্তান্ত, ৫টি ক্যালেন্ডার, ৮ পাতা ডিপিএসের মাসিক হিসাব বিবরণী, ৩টি পাসপোর্ট, একটি ডিভিআর মেশিন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কপি ২৮ পাতা, একটি ব্যানার এবং নগদ ৪ লাখ ২২ হাজার ৮০ টাকা জব্দ করা হয়।
অভিযানের আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি জসিমসহ সমিতির কার্যকরী কমিটি অন্যান্য সদস্যরা পলাতক রয়েছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, মূল অভিযুক্ত জসিম নিজেই সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার এবং কোষাধ্যক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন। এমনকি যুগ্ম সম্পাদকও নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। এটি এক রকম পারিবারিক সমিতি। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদফতর কর্তৃক নিবন্ধনপ্রাপ্ত।
সরকারি হিসেবে, প্রতিষ্ঠানটিতে ৫১৮ জনের কথা উল্লেখ করা হলেও গ্রাহকদের অভিযোগ ও র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটিতে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে। যারা শত কোটির বেশি টাকা লেনদেন করেছেন।
প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি একটি ডিপিএস মাসে এক হাজার টাকা করে বছরে ১২ হাজার টাকা জমা দেয় তবে পাঁচ বছরের ৬০ হাজার টাকা জমা হবে। মেয়াদ শেষে তাকে ৯০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। টার্গেট সংগ্রহকারী ব্যক্তি প্রথম এক বছর প্রতিমাসে ২০০ টাকা এবং পরবর্তী চার বছর প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে লভ্যাংশ পাবেন। আর কোম্পানির কোনো সদস্য যদি নতুন কোনো সদস্যকে এক হাজার টাকার এফডিআর করাতে পারে তাহলে টার্গেট সংগ্রহকারীকে মাসে এক হাজার টাকা এবং এফডিআরকারী সদস্যকে মাসে দুই হাজার টাকা প্রদানের প্রলোভন দেওয়া হতো। প্রকৃতপক্ষে যা দেশে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না।
৫ বছরে ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ মুনাফার ফাঁদ
গ্রেফতার শাকিল আহম্মেদ (৩৩) ও চাঁন মিয়া (৩৮) ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.’ এ বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করতেন। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে বস্তি এলাকার গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি ব্যবসায়ী, ফল ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষেরা বিনিয়োগ করতেন। প্রতি সদস্য মাসিক ১০০ থেকে এক হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতেন। যা তিন বছরে ৩০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৫০ শতাশং মুনাফা প্রদানের শর্তে টাকা গ্রহণ করা হতো।
কিন্তু ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেওয়া হতো না। ডিপিএসের মেয়াদ পূর্ণ হলেও পাওনা টাকা পরিশোধ করা হতো না। অধিক মুনাফার লোভে করোনার সময়েও ভুক্তভোগীরা সঠিক সময়ে ডিপিএসের টাকা জমা দিলেও লভ্যাংশ পায়নি। ভুক্তভোগীরা লাভের টাকা চাইতে গেলে হুমকি-ধমকি প্রদর্শন করা হতো। নারী গ্রাহকদের প্রতি অশালীন মন্তব্য, পুরুষ সদস্যদের টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযান পরিচালনার সময় শাকিলের অফিসের টর্চার সেল থেকে মারধরের সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে।
বিচিত্র ধূর্ত জসিম সব সময়েই ছিলেন আড়ালে
মূল অভিযুক্ত পলাতক আসামি জসিম উদ্দিন মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন। একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে কাজ করলেও ২০০৩ সালে তিনি অল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালে সমবায় অধিদফতর কর্তৃক কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস নিবন্ধন লাভ করে, ২০১৩ সালে সমিতিটি পুনর্নিবন্ধন পায়।
মোজাম্মেল হক বলেন, সমবায় অধিদফতর কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালের তাদের মোট সদস্য সংখ্যা ৫৩৭ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০-২৫ হাজার সদস্য গ্রাহক সংগ্রহ করেছে। জসিম কোম্পানিতে নতুন নতুন সদস্য ভর্তির জন্য পুরাতন সদস্যদের চাপ দিতেন।
গ্রাহকের টাকায় জসিম গড়েছেন আট প্রতিষ্ঠান
কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. ছাড়াও জসিম নিজের নামে-বেনামে আরও সাতটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। জসিম মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কর্নফুলি রিয়েল এস্টেট লি, জসিম ইন্টারন্যাশনাল ওভারসিস লি., জসিম স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি ফার্ম, জসিম ট্যুরস্ অ্যান্ড ট্রাভেলস, জসিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, জসিম নিট কম্পোজিট লি.। এসব কোম্পানির নামে লেনদেন ও টাকা স্থানান্তর করলেও কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস ছাড়া বাকি সাত কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
র্যাব-৪ অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, জসিমের আয়ের মূল উৎস কর্ণফুলী মাল্টিপারপাসে ভুক্তভোগীদের ডিপিএস বা এফডিআরের টাকা। অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির জসিম সমিতির অফিসে আসতেন না। সমিতির ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করতেন। গ্রাহকের টাকায় তিনি বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট, গ্রিন রোডে ফ্ল্যাট, গাজীপুরের মাওনায় রয়েছে আরও দুটি প্লট ও তিন তলা ফ্ল্যাট, মিরপুরে বাড়ি, কাউনিয়া মৌজা ও গাজীপুরে বেশ কয়েক একর জমি ক্রয় করেছেন।
র্যাব-৪ সিও বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল আহম্মেদের (৩৩) নিজ জেলা নরসিংদী। তিনি টঙ্গী কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। ২০১৫ সালে তিনি কর্ণফুলী মাল্টিপারপাসে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। শাকিলের যোগদানের পর থেকে গ্রাহকের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তিনি গ্রাহকদেরকে লোভনীয় অফার দিয়ে সমিতিতে ডিপিএস/এফডিআর এ টাকা রাখতে প্রলুব্ধ করত।
গ্রাহকদের টাকা ফেরতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানি লন্ডারিং মামলার পর গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাওয়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে।
সমবায় অধিদফতরের যেসব কর্মকর্তা অডিট করেছিলেন তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৯-২০২০ সালে সমবায় অধিদফতরের অডিট করে। অডিটে দেখানো হয় মাত্র ৫১৮ জন সদস্য। আর লেনদেন দেখানো হয় মাত্র ৮২ লাখ টাকা। অথচ র্যাবের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে লেনদেন হয়েছে শত কোটির বেশি টাকা। বাকি টাকা মানি লন্ডারিং হয়েছে। মামলার প্রেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন তাহলে সমবায় অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
জসিমসহ পারিবারিক বাকি সদস্যদের গ্রেফতার সম্পর্কে মোজাম্মেল হক বলেন, র্যাবের তথ্য মতে জসিম দেশেই আছে। তাকেসহ পারিবারিক চক্রটির সদস্যদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
জেইউ/ওএফ