সরকারি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সহায়তাসহ বিভিন্ন সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বর্ণবাদমূলক আচরণের শিকার হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সংস্থাটির এক গবেষণায় দেখা গেছে বিদ্যালয়ে মূলধারার সহপাঠী ও শিক্ষকদের বর্ণবাদমূলক আচরণের অভিযোগে সমাধান পাওয়া যায় না, উল্টো বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কম ত্রাণ পেয়ে অভিযোগ করার কারণে আদিবাসী পরিবারের ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে।

আদিবাসী পরিচয়ের কারণে শিক্ষা, ভূমি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিষয়ক লিখিত অভিযোগ দিতে সরাসরি উপস্থিত হলেও তা লিপিবদ্ধ, সংরক্ষণ ও ফলোআপ না করারও উদাহরণ রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) টিআইবি কার্যালয় থেকে ‘সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা: জবাবদিহি ব্যবস্থার বিশ্লেষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষক গোলাম মোস্তফা এসব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন।

গবেষণায় শিক্ষা খাতের তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়েছে, দলিত শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ব্যবহারিক পরীক্ষাগারের সরঞ্জাম ধরতে না দেওয়া প্রসঙ্গে ব্যবহারিক পরীক্ষাগারের শিক্ষককে অভিভাবকরা অভিযোগ জানালে এই শিক্ষক বলেন, ‘আপনাদের (দলিত জনগোষ্ঠীর) সন্তানরা ভালোভাবে ব্যবহারিক পরীক্ষা করতে পারে না। অন্যরা (মূলধারার শিক্ষার্থীরা) তো ঠিকই বলেছে, ভালো হয় আপনাদের সন্তানরা যন্ত্রপাতি না ধরে অন্যরা কিভাবে পরীক্ষা করে তা দেখুক।’

অন্য আরেক জায়গায়, মূলধারার একজন শিক্ষার্থী একজন দলিত শিক্ষার্থীকে তার বাবার পেশা ও বর্ণ পরিচয় নিয়ে করা কটূক্তি করলে তার প্রতিকার পেতে অভিভাবক অভিযোগ করলে শিক্ষক বলেন, ‘আমি কী করতে পারি? আমি তো ওদের এইসব শিক্ষা দেই না। আর ওরা তো বাচ্চা, ওরা এসব বলতেই পারে।’

আরেকটি জায়গায়, শিক্ষক কর্তৃক দলিত শিক্ষার্থীদের দিয়ে বিদ্যালয়ের শৌচাগার পরিষ্কার করানোর প্রতিবাদের কারণে দলিত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অকৃতকার্য করার অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি উপজেলা শিক্ষা এবং সমাজসেবা কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা অভিযোগকারী অভিভাবকদের সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হলে ভালো ফল বয়ে আনবে না বলে হুমকি দেন। বিষয়টি পরবর্তীতে অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

এ বিষয়ে সরকারি সকল সেবায় বর্ণবাদমূলক আচরণের নমুনা কতটুকু এমন প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের গবেষণা পরিসংখ্যানগতভাবে ছিল না। সরকারি সকল সেবার ক্ষেত্রে বর্ণবাদমূলক আচরণ পরিসংখ্যান দিয়ে বলা যাবে না। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করেও সুরাহা পাওয়া যায়নি। অর্থ্যাৎ বর্ণবাদের মানিসকতা গোড়াতেই রয়েছে যা উদ্বেগজনক।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্য সংগ্রহে তদারকির ঘাটতি ও সমন্বয়হীনতার বিষয়টি লক্ষণীয়। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির ঘাটতির কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ, চা বাগানের বিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত সুবিধা ও শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের অনুপস্থিতি রয়েছে। অবাঙালী শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও পরীক্ষার প্রশ্ন বুঝতে না পারার বিষয়ে শিক্ষকদের অসহযোগিতামূলক আচরণ বিদ্যমান।

এছাড়া সমতলে সুপেয় পানির সুবিধা, স্যানিটেশন ও সরকারি টিকাদান কর্মসূচিতে তদারকির ঘাটতির কারণে স্থানীয়ভাবে ডায়রিয়া ও হামের প্রকোপ দেখা যায়। এই প্রকোপকে স্থানীয়ভাবে ‘অজানা অসুখ’ আখ্যায়িত করে তদারকির ঘাটতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিস্বরূপ সর্বোচ্চ অন্যত্র বদলি করা হয়।

গবেষণায় সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উপাত্তের অনুপস্থিতি তাদের প্রতি উদাসীনতা ও অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। তাদের মূলধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। আইনি সীমাবদ্ধতা বা আইনের অনুপস্থিতি, আইনের যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সেবায় অভিগম্যতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান জবাবদিহি কাঠামো অনেক ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। কারণ এক্ষেত্রে তাদের ভাষাগত দক্ষতা, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্য ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের নেতিবাচক মানসিকতা ও চর্চা, অভিযোগ দাখিলে প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়া বরং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হওয়ার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জবাবদিহি কাঠামো ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হয়।

এ বিষয়ে ইফতাখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক, পেশাগত ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যভিত্তিক শ্রেণি পরিচয়ের ন্যূনতম ৩ কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। গবেষণায় আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। তবে এই গবেষণা পরিসংখ্যানগত ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রান্তিক পর্যায়ে মূলধারার মানসিকতা তুলে ধরা। আসলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক সেবা নিশ্চিতে জবাবদিহি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা না হলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ‘কাউকে পেছনে না রাখা’ লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করি।

আরএম/এনএফ