কুয়েত মৈত্রী ও গোমস্তাপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি কেনায় অনিয়ম
চীনা যন্ত্রে ব্র্যান্ডের সিল, অনুসন্ধানে দুদক
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যন্ত্রপাতি ও করোনার সুরক্ষাসামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটায় লুটপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযোগের তির কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সেহাব উদ্দিন ও গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ সারওয়ার জাহানের দিকে।
বিজ্ঞাপন
নামসর্বস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে নিজের শ্যালক ও ভাগ্নেকে কাজ দিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন অনিয়মের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অভিযোগে ৯৩টি বিল কারসাজির তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বিল কারসাজির মাধ্যমে ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকার কার্যাদেশ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ওই দুই চিকিৎসকের নেতৃত্বে বিভিন্ন কৌশলে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে দুদকের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেন সংস্থাটির উপপরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ আরিফ সাদেক। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
সেহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
করোনার চিকিৎসায় নিয়োজিত দেশের প্রথম হাসপাতাল হিসেবে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনায় বড় ধরনের অনিয়মের হয়েছে। কেনাকাটায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বাজার-দরের চেয়ে পাঁচ থেকে ১০ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে।
২০২০ সালের ৩০ মার্চের এক কার্যপত্র অনুসারে ‘মেসার্স আলী ট্রেডার্স’ নামের প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ১২ ধরনের যন্ত্রপাতি কেনায় তিন কোটি ১৮ লাখ ৪১ হাজার ৭৫০ টাকার কার্যপত্র দেওয়া হয়েছে
নামসর্বস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে নিজের শ্যালক ও ভাগ্নেকে কাজ দিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন অনিয়মের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অভিযোগে ৯৩টি বিল কারসাজির তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বিল কারসাজির মাধ্যমে ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকার কার্যাদেশ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে ডা. সেহাব উদ্দিন নিজেই বিভিন্ন নামে ব্যবসা করেছেন। এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন শ্যালক জাকারিয়া ও ভাগ্নে মহিউদ্দিনকে। উদাহরণ হিসাবে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২০ সালের ৩০ মার্চের এক কার্যপত্র অনুসারে ‘মেসার্স আলী ট্রেডার্স’ নামের প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ১২ ধরনের যন্ত্রপাতি কেনায় তিন কোটি ১৮ লাখ ৪১ হাজার ৭৫০ টাকার কার্যপত্র দেওয়া হয়েছে।
কার্যপত্রে যেসব দেশ ও ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সে অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়নি। চীন থেকে যন্ত্রপাতি কিনে যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে
মার্চ মাসেই এভাবে আরও তিনটি কার্যপত্র দেওয়া হয়েছে। ১২ মার্চের কার্যপত্রের মাধ্যমে সাত ধরনের যন্ত্রপাতি কেনায় এক কোটি ৪২ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ১৫ মার্চ ১১ ধরনের যন্ত্রপাতি কেনায় দুই কোটি ৮৩ লাখ সাত হাজার ৫০০ টাকা এবং ২৫ মার্চ পাঁচ ধরনের যন্ত্রপাতি কেনায় এক কোটি ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কার্যাদেশ দেন ডা. সেহাব উদ্দিন। এসব ভারী যন্ত্রপাতি কেনায় ব্যয় হয় আট কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার ২৫০ টাকা। প্রতিটি যন্ত্রপাতি প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে ভুয়া ওই প্রতিষ্ঠানকে কেনার জন্য দেওয়া হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, গত ৩০ মার্চে সই করা কার্যপত্রের ছয় নম্বর তালিকায় পিসিআর মেশিনের দাম ধরা হয়েছে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অথচ এ মানের একটি পিসিআর মেশিনের দাম ২৫ লাখ টাকা। একই কার্যপত্রের ৪ নম্বরে ডিফিব্রিলেটর নামের একটি যন্ত্রের দাম ধরা হয়েছে নয় লাখ ৮১ হাজার টাকা। অথচ এর দাম সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা।
কার্যপত্রের ৫ নম্বরে সেন্ট্রাল মাল্টিপারপাস প্যাশেন্ট মনিটর নামে যন্ত্রটির দাম ধরা হয়েছে ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ এ মেশিনের সর্বোচ্চ দাম ১০ লাখ টাকা। কার্যপত্রে যেসব দেশ ও ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সে অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়নি। চীন থেকে যন্ত্রপাতি কিনে যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সারওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সারওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, করোনাকালে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) ও স্বাস্থ্য সহকারীদের জন্য বরাদ্দ সুরক্ষাসামগ্রী লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া করোনা রোগীর চিকিৎসা না করেও হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, ভেষজ বাগান কেটে ফুলের বাগান তৈরি, এসি মেরামতের নামে কোটেশন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, জঙ্গি মামলার আসামি ও নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া দুই উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারকে আইন লঙ্ঘন করে টাকার বিনিময়ে পদে বহাল, সরকারি গাড়ির অপব্যবহার, স্টাফদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে বদলি, হুমকি-ধমকি এবং টেন্ডার ছাড়াই ফল বিক্রিসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি ও অনুদানের পিপিই মিলিয়ে ৬০০ এর বেশি পিপিই লোপাট হয়েছে। প্রতিটি পিপিইর মূল্য ন্যূনতম দুই হাজার টাকা ধরলে তিনি ৬০০ পিপিইর ১২ লাখ টাকা এবং অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী থেকে আরও প্রায় পাঁচ লাখ টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন
স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী লুটপাটের অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ছয় থেকে সাতটি সেকশন, কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি ও অনুদানের পিপিই মিলিয়ে ৬০০ এর বেশি পিপিই লোপাট হয়েছে। প্রতিটি পিপিইর মূল্য ন্যূনতম দুই হাজার টাকা ধরলে তিনি ৬০০ পিপিইর ১২ লাখ টাকা এবং অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী থেকে আরও প্রায় পাঁচ লাখ টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, সরকারিভাবে নিজ অফিস কক্ষ ও বাসভবনে এসি ব্যবহারের অনুমতি না থাকলেও হাসপাতালের ওটি, এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি রুম থেকে পাঁচটি এসি খুলে নিজ অফিস কক্ষ, বাসভবন, চিকিৎসকদের বিশ্রাম ও আরএমও কক্ষে প্রতিস্থাপন করেছেন ডা. সারওয়ার জাহান।
আরএম/আরএইচ/এমএআর