দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী। নদীটি আজ দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত। দিন দিন বাড়ছে নদীর জায়গা দখল আর দূষণ। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামের একটি সংগঠন বলছে, ২০১৪ সালে শাহ আমানত ব্রিজের নিচে কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল ৮৬৬ মিটার। এখন তা ৪১০ মিটারে এসে ঠেকেছে। নদীর জায়গা দখল করেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়েও কর্ণফুলী দখলের মহোৎসব চলছে।

ফিরিঙ্গিবাজার থেকে নতুন মাছবাজার, ভেড়া মার্কেট থেকে বাকলিয়া চরের মোড় পর্যন্ত এক হাজারের ওপরে অবৈধ স্থাপনা আছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর নোটিশ প্রদান করা হয়। নোটিশ দেওয়ার ১০ মাস অতিবাহিত হলেও রহস্যজনক কারণে এত দিন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেনি জেলা প্রশাসন। 

তবে বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে কর্ণফুলী নদী দখল করে যারা অবৈধ স্থাপনা করেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে বাঁচাতে হলে কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হবে। আর কর্ণফুলী বাঁচাতে হলে ৫০ থেকে ১০০ বছর মেয়াদি একটি মাস্টার প্ল্যান দরকার। 

২০১৪ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাস্টার প্ল্যান ফর চিটাগং পোর্ট’ শীর্ষক জরিপে চাক্তাই খালের মুখে কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা ছিল ৯৩৮ মিটার। রাজাখালী খালের মোহনায় তা ছিল ৮৯৪ মিটার। শাহ আমানত সেতুর নিচে ছিল ৮৬৬ মিটার।

কিন্তু ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতু থেকে ফিরিঙ্গিবাজার মনোহরখালী পর্যন্ত এর প্রস্থ জরিপ করে। বিএস শিট, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রণীত কৌশলগত মহাপরিকল্পনা ২০১৪-এর সঙ্গে তুলনা করে এ জরিপ করা হয়।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে শাহ আমানত সেতুর নিচে কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা ছিল ৮৬৬ মিটার প্রস্থ। এখন তা ভাটার সময় দাঁড়িয়েছে ৪১০ মিটারে। জোয়ারের সময় তা ৫১০ মিটার পর্যন্ত পাওয়া গেছে। রাজাখালী খালের মুখে প্রশস্ততা ৪৬১ মিটার পাওয়া গেছে, যা আগে ছিল ৮৯৪ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে এখন নদীর প্রশস্ততা ৪৩৬ মিটার, যা আগে ছিল ৯৩৮ মিটার। ফিরিঙ্গিবাজার মোড়ে নদীর প্রস্থ ছিল ৯০৪ মিটার, বন্দর কর্তৃপক্ষ খননের পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশ বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছামতো গাইড ওয়াল নির্মাণ করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে বলে জরিপে বলা হয়েছে।

জরিপ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শাহ আমানত সেতুর উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে নদী ভরাট করে গড়ে তোলা মাছবাজার, বরফকল, অবৈধ দখল ও ভেড়া মার্কেটের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা কমে দাঁড়ায় ৪৬১ মিটারে। মূলত কর্ণফুলী নদী অবৈধ দখলের কারণে এর প্রশস্ততা কমছে বলে অভিযোগ নদী রক্ষা আন্দোলনকারী ও বিশেষজ্ঞদের। 

ফিরিঙ্গি বাজার মোড় থেকে মেরিনার্স পার্ক নতুন মাছবাজার, ভেড়া মার্কেট থেকে বাকলিয়া চরের মোড় পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ও  প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকা সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বিগত ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর উচ্ছেদ নোটিশ প্রদান করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। ওই নোটিশ প্রদানের পর এক বছর ১০ মাস অতিবাহিত হলেও রহস্যজনক কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে না জেলা প্রশাসন। যা মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। 

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বারবার তাগাদা সত্ত্বেও কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করায় আগামী ১৫ দিনের মধ্যে হাইকোর্টের আদেশ অবমাননার অভিযোগ এনে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার চাইবে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন। মাছবাজার ও ভেড়া মার্কেট উচ্ছেদের বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশের ৪ নম্বর কলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ তার তোয়াক্কা না করেই নতুন মাছবাজার চলমান রেখেছে।

এছাড়া ১৫ বছরের চুক্তিনামা দিয়ে কর্ণফুলী নদী দখল ও ভরাট করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করেছে। ২০১৯ সালের আদেশের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নতুন মাছবাজার উচ্ছেদ করা বাধ্যতামূলক ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ মাছবাজার উচ্ছেদ না করে নতুন করে বরফকল স্থাপনের জন্য কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে শাহ আমানত ব্রিজের মাঝপিলার বরাবর ২০০০ স্কয়ার ফিট নদী নতুন করে লিজ দিয়েছে। যা সরাসরি হাইকোর্টের আদেশের লঙ্ঘন।

জানা গেছে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সম্প্রতি ১৫ দিনের মধ্যে কর্ণফুলীর মোহনাসহ নদীতীরের অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক প্রতিবেদন দিতে বলেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (আহ্বায়ক, চট্টগ্রাম জেলা নদী রক্ষা কমিটি), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়ে এ প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। ‘কর্ণফুলী নদী দখল করে গড়ে ওঠা মাছবাজার ও মেরিনার্স পার্কের নামে বালুমহালসহ অন্যান্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আবেদন’ শিরোনামে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন গত ২৮ আগস্ট ওই চিঠি দেয়। চিঠিতে স্বাক্ষর করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম।

নদী রক্ষা কমিশনের বেধে দেওয়া ১৫ দিন সময় পার হয়ে গেছে অনেক দিন আগেই। কিন্তু এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সংস্থার তরফে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি। 

গত ১১ অক্টোবর (সোমবার) চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, হাইকোর্টের আদেশে জলাশয় সংরক্ষণ আইন ২০০০ এর ধারা ৫ অনুযায়ী, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণিকর্তন (পরিবর্তন) করা যাবে না। ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তরও করা যাবে না। কিন্তু বিএস ১নং খতিয়ানের ৮৬৫১ দাগ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদী জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডকে ২০১৫ সালে ১৫ বছরের চুক্তিনামা দিয়ে নদী দখল ও ভরাট করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করেছে। 

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলনে আরও দাবি করা হয়, মাছবাজার ও ভেড়া মার্কেট উচ্ছেদের বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশের ৪ নম্বর কলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ তা তোয়াক্কা না করেই নতুন মাছবাজার চলমান রেখেছে। ২০১৯ সালের আদেশের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নতুন মাছবাজার উচ্ছেদ করা বাধ্যতামূলক ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ মাছবাজার উচ্ছেদ না করে নতুন করে বরফকল স্থাপনের জন্য কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে শাহ আমানত ব্রিজের মাঝপিলার বরাবর ২০০০ স্কয়ার ফিট নদী নতুন করে লিজ দিয়েছে। যা সরাসরি মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের লঙ্ঘন।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের নেতারা আরও বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীতে স্থাপিত মাছবাজার ও বরফ কলের চুক্তি বাতিল করতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বন্দর চেয়ারম্যান বরাবর ১০ দিনের সময়সীমা দিয়ে আবেদন করেছিলাম। এ বিষয়ে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের জানায়নি। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনায় জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর চুক্তির মাধ্যমে সেই জায়গা দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৫ বছরের ওই চুক্তির ফলে সে জায়গায় এখন অন্তত ১৮শ’ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ওই মাছবাজারের কারণে কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে এবং পানির চলমান প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। বন্দর চেয়ারম্যানকে অনতিবিলম্বে ওই চুক্তি বাতিলের আহ্বান জানান চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কমিটি। 

এছাড়া চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনায় নদী ভরাট করে মাছবাজার গড়ে ওঠায় উজানের চেয়ে ভাটির মোহনা অংশ উঁচু হয়ে গেছে বলে চুয়েট প্রফেসর ড. স্বপন কুমার পালিতের নেতৃত্বে ২০১৮ সালে জরিপে দেখা যায়। যে কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি বাকলিয়া, পাঁচলাইশ ও চকবাজার থানা এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

এসব স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উপব্যবস্থাপক (ভূমি) জিল্লুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে যেসব অবৈধ স্থাপনা আছে সব উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন যেগুলো উচ্ছেদের বাকি আছে তা করবে জেলা প্রশাসন।

মেরিনার্স পার্ক ও মাছবাজার উচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের এখানে তো অবৈধের কিছু নেই। আর হাইকোর্ট থেকে যে উচ্ছেদের তালিকা দেওয়া হয়েছে সেই তালিকায় মাছবাজার নেই।

নদী রক্ষা কমিশন থেকে মাছবাজার উচ্ছেদের বিষয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদী রক্ষা কমিশন তো কোনো রেগুলেটরি কমিশন নয়। নদী রক্ষা কমিশন হচ্ছে তথ্য অধিকার কমিশনের মতো একটি কমিশন। তাদের যদি নির্বাহী কোনো বিষয় থাকত তাহলে সব কর্তৃপক্ষের জন্য আদেশ মানা বাধ্যতামূলক হতো। হাইকোর্টের তালিকা ধরে আমরা উচ্ছেদ করে ফেলেছি। মাছবাজার নিয়ে হাইকোর্টের কোনো আদেশ নেই। সঙ্গত কারণেই তা উচ্ছেদ করা যাবে না। 

তিনি আরও বলেন, সমুদ্র থেকে প্রচুর পরিমাণ মাছ ধরা হয়। তাদের (জেলে) তো মাছ তোলার জায়গা দিতে হবে। বাজার হওয়ার ফলে জেলেরা উপকৃত হয়েছেন। ‘এমন কিছু লোক আছে, যারা দরখাস্ত দিয়ে বলে এদেরকে তোলো, ওদেরকে তোলো; অথচ  কাদেরকে তুলতে হবে, হাইকোর্ট কিন্তু বলে দিয়েছেন। হাইকোর্টের তালিকায় যেহেতু তারা নেই, তাদের তো উচ্ছেদ করা যাবে না।’ 

প্রসঙ্গত, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সর্বোচ্চ আদালত ২০১৯ সালে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। রায়ে দুই হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা সরাতে ৯০ দিনের সময় দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসন ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ১০ একর ভূমি উদ্ধার করে। এ অভিযানের ফলে অবমুক্ত হয় পাঁচটি খালের মুখ। বন্দর এলাকা থেকে শুরু করে বারিক বিল্ডিং মোড়-গোসাইলডাঙ্গা-সদরঘাট-মাঝির ঘাট-শাহ আমানত সেতু হয়ে মোহরা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার নদীর তীর জঞ্জালমুক্ত হয়। এরপর লালদিয়ার চর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে একদিকে যেমন নতুন অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠছে তেমনি উচ্ছেদের জায়গাগুলোও ফের দখল হয়ে গেছে। 

সরেজমিন দেখা যায়, ফিরিঙ্গিবাজার থেকে নতুন ব্রিজের পশ্চিম পাশ পর্যন্ত এলাকায় প্রতিদিনই গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা। ব্রিজের পশ্চিমে লাগোয়া জায়গাটি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ট্রাক ও বাস টার্মিনাল। চলছে বালি দিয়ে ভরাটকাজ। সেখান থেকে রাজাখালী খালের মুখ পর্যন্ত গড়ে উঠছে নতুন নতুন দোকান।

এছাড়া নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মৎস্য আড়ত। উচ্ছেদ ঠেকাতে নির্মাণ করা হয়েছে ধর্মীয়সহ নানা স্থাপনা। সদরঘাট এলাকায় উচ্ছেদ করা স্থানগুলো এখন ব্যবহার হচ্ছে ট্রাক-লরি ও পণ্য লোড-আনলোডের ঘাট হিসেবে। ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার নেভাল-২ এর কাছাকাছি স্থানে বাঁশের ব্যবসা শুরু করেছেন কেউ কেউ।

প্রতিনিয়ত দূষণের কবলে পড়ছে কর্ণফুলী পরিবেশ। চট্টগ্রাম নগরী থেকে খাল দিয়ে কলকারখানার বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলীতে। এছাড়া জাহাজের পোড়া তেল পড়ে দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলীর পানি। ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিটি খালের মুখে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ১ মিলিগ্রামের নিচে। সব শাখা খালেরই প্রায় একই অবস্থা। এছাড়া কর্ণফুলী পেপার মিলের বর্জ্যেও দূষিত হচ্ছে পানি। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর্ণফুলী নদীর দখল ও দূষণ রোধে কারও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনেরই উদ্যোগ নেওয়ার কথা, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় কর্ণফুলীর জায়গা লিজ দেওয়া হচ্ছে! 

তিনি আরও বলেন, কর্ণফুলীতে একসময় প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যেত। ১৯৮৬ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৯ প্রজাতির মিশ্র মাছ, ৬৫ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ, বিভিন্ন প্রজাতির ১৫ প্রকারের পরিযায়ী মাছ পাওয়া যেত কর্ণফুলীতে। এ গবেষণাকে ভিত্তি করে ২০০৯ সালে কর্ণফুলী নদীর মাছ ও দূষণের ওপর আরেকটি গবেষণা করা হয়। তাতে দেখা যায়, মিশ্র পানির ২৫ প্রজাতির, মিঠা পানির ৩০ প্রজাতির এবং পরিযায়ী প্রজাতির মাছ প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, প্রতিনিয়ত দূষণে কর্ণফুলী নদী থেকে মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। বর্তমানে টেংরা জাতীয় ফাইস্যা, পোয়া ও কাঁচকি ছাড়া অন্য প্রজাতির মাছ তেমন পাওয়া যায় না। কর্ণফুলীতে বর্তমানে ড্রেজিং চলছে। ড্রেজিংয়ে প্রচুর পলিথিন পাওয়া যাচ্ছে।

‘কর্ণফুলীর পরিবেশ দিন দিন খারাপ হচ্ছে। নদীর দূষণ মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রতিটি খালের মুখে দবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ পাওয়া গেছে ১ মিলিগ্রামের নিচে। কোনো শাখা খালেই ১-এর উপরে নেই। স্বাভাবিকভাবেই এমন পরিস্থিতিতে খালের মুখগুলোতে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। এছাড়া জাহাজের তেল, কর্ণফুলী পেপার মিলের বর্জ্য, সিটি করপোরেশনের আবর্জনা ও কলকারখানার বর্জ্যে কর্ণফুলীর দূষণ বাড়ছে। 

মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, বন্দরকে বাঁচাতে হলে কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হবে। কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হলে ৫০ বছর বা ১০০ বছর মেয়াদি একটি মাস্টার প্ল্যান গ্রহণ করতে হবে। এ মাস্টার প্ল্যান করতে হবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে। কর্ণফুলীর মালিকানা হচ্ছে বন্দরের। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর এখনও কোনো মাস্টার প্ল্যান করেনি কর্ণফুলী রক্ষার জন্য। উল্টো বন্দর কর্ণফুলীর জায়গা বিভিন্নভাবে লিজ দিচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম ওয়াসাকে একসাথে কাজ করতে হবে। এছাড়া কর্ণফুলীকে রক্ষার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলীর কর্ণফুলীর ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন নর্থ আমেরিকান রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী দখল ও দূষণে জড়িত। দখলের কারণে দিন দিন নদীর প্রশস্ততা কমেছে। আর জনগণের অসচেতনতায় পলিথিনের স্তর পড়েছে কর্ণফুলীর তলদেশে। 

তিনি আরও বলেন, যারা নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা করে, তারা নদীটাকে ছিড়েখুড়ে খাচ্ছে। এখানে সবাই নীরব। ড্রেজিংয়ের নামে কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা কমে এসেছে। ড্রেজিংকে ব্যবসায় রূপান্তর করা হয়েছে। নদীকে অবলম্বন করে আগে আমরা ব্যবসা করতাম। এখন নদী হয়ে গেছে ব্যবসার উপাদান। এছাড়া কর্ণফুলী নদী তদারকি কেউই করছে না। কর্ণফুলীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। সেই নদী দখল করা হচ্ছে দিন দিন।

তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত কর্ণফুলী নদীর ওপর নজর দেওয়ার। নদী কমিশন করে তাদের ক্ষমতা দেওয়া। যাতে নদী রক্ষায় কাজ করতে পারে। কর্ণফুলীকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান করা দরকার। নদীর দখলদারদের দ্রুত উচ্ছেদ করতে হবে। কারণ, দখলের কারণেই নদীর প্রশস্ততা কমে গেছে। পাশাপাশি নদীর দূষণ কমাতে পরিবেশ অধিদফতরকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আমরা আগেও অভিযান চালিয়েছিলাম। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ থেকে ফের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হবে। কোনো অবৈধ স্থাপনাই থাকবে না। 

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে চলছে কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ৩০২ কোটি টাকার প্রকল্পের  ৫০ শতাংশের ওপরের কাজ।

কেএম/এইচকে