পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় জামালপুরের সুমন মিয়া (৩৮) ও সিরাজগঞ্জের স্বর্ণা বেগমের (৩৫)। বিয়ের পর তারা জামালপুরেই থাকতেন। যৌতুকের দাবিতে সুমন প্রায়ই নির্যাতন করতেন স্বর্ণাকে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। যৌতুকের মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলও খাটেন সুজন। পরে পারিবারিক বৈঠকে সমঝোতায় মামলা উঠিয়ে নেওয়া হয়। 

পরে সুজন বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে স্বর্ণা সন্তানদের নিয়ে সিরাজগঞ্জে বাবার বাড়িতে চলে যান এবং আশুলিয়ার একটি গার্মেন্টেসে চাকরি নেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর তারা দুজন দেখা করেন। আবারও যৌতুকের দাবিতে ঝগড়ার এক পর্যায়ে স্বর্ণার গায়ে গরম তেল ঢেলে পালিয়ে যান সুজন। পরে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ দিন পর মারা যান স্বর্ণা।

এ ঘটনা চাঞ্চল্য ছড়ালে মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) রাতে জামালপুর থেকে সুজন মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এলআইসি শাখার একটি দল।

এ বিষয়ে বুধবার দুপুরে মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এলআইসি শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, যৌতুকের টাকা না পেয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ২টার দিকে ঢাকার আশুলিয়া থানার জিরানীর টেঙ্গুরী এলাকার ভাড়া বাসায় স্বর্ণা বেগমকে গরম তেল ঢেলে পালিয়ে যান স্বামী সুজন মিয়া। 

ওই বাসার সদস্য হাফিজুর ও অন্যান্যরা স্বর্ণাকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঘটনাস্থল থেকে জামালপুরের সরিষাবাড়ীর পিংনা গ্রামে নিয়ে যান। কিন্তু সুজন মিয়ার পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলেও ভর্তি না করেই ফেলে পালিয়ে যান। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উন্নত চিকিৎসার জন্য স্বর্ণা বেগমকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সাজারি ইনস্টিটিটিউটে পাঠায়। ১২ দিন পর মারা যান স্বর্ণা। ওই ঘটনায় স্বর্ণার মা মোছা. শিরিনা বেগম (৫০) আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে জামাতা সুজন মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।


 
মুক্তা ধর বলেন, যৌতুক চেয়ে গরম তেল ঢেলে হত্যার ঘটনা চাঞ্চল্য ছড়ালে সৃষ্টি করলে সিআইডির এলআইসি শাখা ছায়া তদন্ত শুরু করে ও সুজন মিয়াকে জামালপুর থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সুজন মিয়া জানান, ২০০৭ সালে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা জামালপুরেই গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। স্থানীয় বাজারে রেডিমেড গার্মেন্টসে দোকানদারি করতেন সুজন। তাদের ১৪ বছরের সংসারে ওমর ফারুখ সিফাত (১১) নামে ছেলে ও মোসাম্মৎ খাদিজা নামে দুই বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে।
 
পারিবারিক কলহের সূত্রপাত ও হত্যার কারণ সম্পর্কে মুক্তা ধর বলেন, স্বামীর বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে বাধা দেওয়া, সংসারের ভরণ-পোষন সঠিকভাবে না দেওয়া এবং যৌতুকের দাবিতে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। এর আগে যৌতুকের দাবিতে মারপিট করে গুরুতর জখম করায় স্বর্ণার দুলাভাই ময়নুল ইসলাম বাদী হয়ে সুজন মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করলে দুই মাস ১৯ দিন কারাভোগ করেন সুজন। পরে পারিবারিক সমঝোতায় মামলাটি প্রত্যাহার করে ভুক্তভোগীর পরিবার। কিন্তু কিছুদিন পরই আবারো নির্যাতন শুরু করেন সুজন। নির্যাতন সইতে না পেরে বাবা-মায়ের কাছে সিরাজগঞ্জে চলে যান স্বর্ণা।
 
আর্থিক অভাব-অনটনে সন্তানদের মায়ের কাছে রেখে আশুলিয়ার জিরানী বাজার এলাকার ডরিন গার্মেন্টেসে চাকরি নেন। সুজন মিয়াও কৌশলে স্ত্রীর ঠিকানা সংগ্রহ করে ২৪ সেপ্টেম্বর পুনরায় যৌতুকের দাবি নিয়ে সেখানে যান এবং ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হন। 

যৌতুক দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় ২৫ সেপ্টেম্বর রাত দুইটার দিকে পরিকল্পিতভাবে ঘুমন্ত স্ত্রীর শরীরে গরম তেল ঢেলে দেন সুজন। এতে স্বর্ণার শরীরের ৫২ শতাংশ পুড়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পালিয়ে যান সুজন। স্বর্ণাকে দগ্ধ অবস্থায় আশুলিয়া হতে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফেলে রেখে পালিয়ে যায় আত্মীয়রা। উন্নত চিকিৎসার জন্য স্বর্ণাকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিটিউটে ভর্তি করা হলে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রায় ১২ দিন পর মৃত্যুবরণ করেন স্বর্ণা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সুজন মিয়া স্ত্রীকে গরম তেল শরীরে ঢেলে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।

জেইউ/আরএইচ