রাজধানীর পল্লবীর তিন কলেজ শিক্ষার্থীকে উদ্ধারের পর র‌্যাব বলছে এই শিক্ষার্থীরা ভয়ংকর একটি মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছিলেন; যদিও স্বাধীন জীবনযাপন ও উচ্চশিক্ষার জন্য জাপান যাওয়ার চিন্তা থেকে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন ৩ শিক্ষার্থী। সময় মতো উদ্ধার করা না গেলে তাদের আরও বড় বিপদে পড়তে হতো বলে মনে করছেন র‌্যাব সদস্যরা।  

নিখোঁজের ৫ দিন পর গতকাল (বুধবার) আব্দুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে ওই তিন কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। তিন কিশোরী মিরপুর-পল্লবী এলাকার তিনটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। গতকাল তাদের উদ্ধারের পর র‌্যাব জানায়, অতিরিক্ত পারিবারিক বিধিনিষেধে বিরক্ত হয়ে এবং উচ্চবিলাসী জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে জাপান চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ঘর ছেড়েছিলেন তারা। 

এ তিন শিক্ষার্থীর ঘর ছাড়ার সঙ্গে হাফসা চৌধুরী নামে মানবপাচার চক্রের একজনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেলেও র‌্যাব মনে করছে এ নামটি ভুয়া। চক্রের কোনো সদস্যকে আটকও করা যায়নি।  

সব মিলিয়ে এ তিন শিক্ষার্থীদের উদ্ধারের পর র‌্যাব এখন ধারণা করছে, এখানে আসলে একটা মানবপাচারকারী চক্র কাজ করছে।  র‍্যাব-৪ এর সন্দেহ, চক্রটির সদস্যরা শুধু ওই তিন শিক্ষার্থী নয়, তাদের মতো আরও অনেক অল্পবয়সী তরুণীকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে থাকতে পারে। চক্রটি নারীপাচার, মুক্তিপণ আদায়, টাকা-পয়সা লুট ও ক্ষেত্র বিশেষে হত্যার মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। 

র‍্যাবের মতে, চক্রটি প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এতটাই পারদর্শী যে তাদের ট্রেস করা যায় এমন কোনো আলামত তারা পেছনে রাখে না। সুকৌশলে ভুক্তভোগীদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করে চক্রটি। এদের বিষয়ে বেশকিছু তথ্য র‍্যাব-৪ এর হাতে এসেছে।  

ওই তিন শিক্ষার্থী সম্পর্কে র‍্যাব-৪ এর একাধিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, নিখোঁজের দুই মাস আগে ওই তিন শিক্ষার্থী রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় তাদের বন্ধু তরিকুলের মাধ্যমে হাফসা চৌধুরী নামে যে নারীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন সে আসলে ওই চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। সে মূলত ভুয়া নাম ব্যবহার করে ওই তিন শিক্ষার্থীকে জাপানে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। তবে তার আসল নাম এখনো জানতে পারেনি র‍্যাব।

চক্রটির বিষয়ে যা ধারণা করা হচ্ছে
নতুন এই চক্রটিকে শনাক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তদন্তকারীদের। ধারণা করা হচ্ছে, চক্রটি এক সঙ্গে বিভিন্ন পরিবারের তরুণীদের টার্গেট করে তাদের কার্যক্রম চালায়। দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণীদের ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে নিয়ে গিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ হয় এমন জায়গায় বিক্রি করে দেয়।

অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণীদের জাপানসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে পাঠানোর কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকাসহ ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে। পরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আটকে রেখে তাদের টাকা-পয়সা লুট করে এবং পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে রেখে যায়। ওই তিন শিক্ষার্থীর টাকা এবং স্বর্ণালংকারও চক্রটির সদস্যরা কক্সবাজার থেকে নিয়ে যায়। আবার কোনো ভিকটিমকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে হত্যা করার মতো ঘটনাও চক্রটি ঘটাতে পারে। 

যেভাবে অদৃশ্য হয়ে আছে চক্রটি
র‍্যাব সূত্রে জানা গেছে, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে চক্রটির সদস্যরা একপাক্ষিক যোগাযোগ ব্যবস্থা অবলম্বন করে। ভুক্তভোগীরা নিজেরা চাইলেই চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না, চক্রটি যখন চায় তখনই কেবল যোগাযোগ হয়। এ তিন শিক্ষার্থীর সঙ্গেও তেমনটাই হয়েছিল। এখানেও ‘ট্রেসলেস’ একটা সম্পর্ক তৈরি করা হয়। চক্রটি কোনো সিম ব্যবহার করে যোগাযোগ করে না। মেসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। পরে আইডির আর কোনো খোঁজ থাকে না। ভুক্তভোগীদের দিয়ে তাদের পাঠানো মেসেজগুলোও ডিলিটি করিয়ে দেওয়া হয়। পারতপক্ষে তারা সামনাসামনি দেখা করে না। 

র‍্যাব-৪ এর এক কর্মকর্তা বলেন, চক্রটি খুঁজে বের করার জন্য আমরা তিন শিক্ষার্থী নিখোঁজের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তভার চেয়েছি। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্লু আছে। তদন্তের দায়িত্ব পেলে চক্রটিকে এক্সপোজ করা যাবে বলে আশা করি।

এদিকে মামলার তদন্তের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক সজিব খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই মামলায় মো. তরিকুল্লাহ (১৯) ওরফে তরিকুলের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে এখন পর্যন্ত। আমাদের তদন্ত চলছে। ওই তিন শিক্ষার্থীকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে র‍্যাব। মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব। 

এই তিন শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার পর তাদের একজনের বড় বোন ২ অক্টোবর পল্লবী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন একটি মামলা করেন। এই মামলায় আসামি করা হয়- মো. তরিকুল্লাহ (১৯), মো. রকিবুল্লাহ (২০), জিনিয়া ওরফে টিকটক জিনিয়া রোজ (১৮) ও শরফুদ্দিন আহম্মেদ অয়নকে (১৮)। এছাড়া অজ্ঞাত চারজনকেও আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে  তরিকুল্লাহ, রকিবুল্লাহ, জিনিয়া ও অয়ন গ্রেফতার আছেন।

ঘটনার শুরু থেকে শেষ 
র‌্যাব বলছে, পড়াশোনা ও ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার জন্য পরিবারের চাপে বিরক্ত ছিলেন এই তিন বান্ধবী। এরসঙ্গ স্বাধীন জীবনযাপন ও উচ্চশিক্ষার জন্য জাপান যাওয়ার একটা চিন্তা ছিল। এরইমধ্যে দুই মাস আগে তারা তাদের এক বন্ধু তরিকুলের সঙ্গে দিয়াবাড়িতে ঘুরতে যান। সেখানে হাফসা চৌধুরী নামে এক নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। ওই নারীর সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানান। পরে তাদের ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয় এবং হাফসা চৌধুরী তাদের জাপান যেতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। 

জাপান যাওয়ার উদ্দেশেই ৩০ সেপ্টম্বর ঘর থেকে বের হন তারা। উদ্দেশ্য ছিল কক্সবাজার দিয়ে সমুদ্রপথে জাপান যাবেন তারা। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে তারা গাবতলী যান। হাফসার পরামর্শে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে তারা নিজেদের ইমেইল, ফেসবুক আইডি ও ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলী থাকতেই নষ্ট করে ফেলেন।

এরপর তারা নৌকায় নদী পার হয়ে আমিনবাজার যান। সেখান থেকে হাফসার দুজন লোক একটি কালো রঙের নোয়া গাড়িতে করে তাদের নিয়ে যান। পরে তাদের রাজধানীর অজ্ঞাত একটি স্থানে নামিয়ে দিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে যেতে বলেন এবং সেখান থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিন বান্ধবী তাদের কথামতো কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে চট্টগ্রামগামী কোনো ট্রেন না পেয়ে বাসে করে কুমিল্লার ময়নামতি যান। 

পথে তারা নিজেদের  বেশভূষা পরিবর্তন করে ফেলেন। ময়নামতি থেকে তারা বাসে চট্টগ্রাম যান এবং সেখান থেকে দুটি মোবাইল কিনে কক্সবাজারের উদ্দেশে বাসে ওঠেন। 

মোবাইল কিনলেও আত্মগোপনে থাকার জন্য তারা কোনো সিম কেনেননি। ১ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজারের কলাতলীর একটি হোটেলে অবস্থান করে তারা। সেখানে ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। ২ অক্টোবর তারা কক্সবাজার সৈকত এলাকায় বেড়াতে গেলে হাফসার লোক পরিচয়ে আসিফ ও শফিক নামে দুজন তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা নিয়ে নেয়।

এ ঘটনায় তিন বান্ধবী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং দুই দিন হোটেলেই অবস্থান করে। পরে তারা হোটেলের আশপাশে র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ৫ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে ছদ্মবেশে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। বুধবার সকালে ঢাকার আব্দুল্লাহপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পৌঁছালে র‌্যাব তাদের উদ্ধার করে।

এমএসি/এনএফ