আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। রাসেল কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে আর তার স্ত্রী গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন।

রাসেলকে দুই দফায় চার দিন আর তার স্ত্রীকে তিন দিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন ও চার্জশিট প্রস্তুত করছে পুলিশ।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল গ্রাহকের ক্ষোভ, ইভ্যালির দায়-দেনা ও বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে দাবি করেছেন। পুলিশকে তিনি বার বার বলেছেন- ‘একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য এই দায়-দেনা অস্বাভাবিক কিছু নয়!’

সূত্রটি জানায়, রাসেল পুলিশের কাছে ইভ্যালির দায়-দেনার সর্বশেষ হিসাব দিয়েছেন। সেই হিসাব ও নিজস্ব অনুসন্ধানের আলোকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করছে পুলিশ। পুলিশের প্রতিবেদনে ইভ্যালির দায়-দেনার বিষয়ে রাসেলের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যগুলো তুলে ধরা হচ্ছে। সেখানে রাসেল জানান, গত ১৯ ও ২৬ আগস্ট এবং ২ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানের সম্পদের দায় বিবরণী, গ্রাহকের দেনা, গ্রাহকের সংখ্যা ও মার্চেন্টদের দায়-দেনার বিষয়ে অডিট করেন তিনি।

সেই অডিটের রিপোর্ট অনুযায়ী তার দায়ের পরিমাণ ৫৪২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে মার্চেন্টরা পাবেন ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মার্চেন্টদের দেনার বিষয়ে রাসেল পুলিশকে জানান, যে কোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্রেডিট একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সব ধরনের ব্যবসাতেই এটি আছে। এছাড়া মার্চেন্টরা ইভ্যালির মাধ্যমে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে মুনাফা পাচ্ছেন। তাই মার্চেন্টদের (২০৫ কোটি ৮৬ লাখ) যে দেনা রয়েছে এটি স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য একটি পরিমাণ।

আরও পড়ুন : ই-কমার্স ও ইভ্যালি : সুন্দর সমাধানের উপায়

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসেল জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, সর্বশেষ ১৬ আগস্ট পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছে ইভ্যালির ৩১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা দেনা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোনো পণ্যের অর্ডারে সর্বোচ্চ ১০ ভাগ অগ্রিম টাকা পরিশোধের অনুমতি দিচ্ছে। যখন অর্ডার নেওয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং ইভ্যালিতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ আসবে তখন তিনি এই টাকা ফিরিয়ে দেবেন। যদিও বিনিয়োগ প্রাপ্তির অগ্রগতি ‘শূন্য’ বলে স্বীকার করেন তিনি।

ডেলিভারি দেরির পেছনে যে ‘অজুহাত’ দিয়েছেন রাসেল

গ্রাহকের পণ্য না দেওয়ার দায় ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতাদের ওপর চাপিয়েছেন রাসেল। গুলশান ও ধানমন্ডি থানার তথ্য অনুযায়ী, রাসেল জিজ্ঞাসাবাদে পণ্যের সঠিক ডেলিভারি না হওয়ার পেছনে ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান (তৃতীয় পক্ষ) ও বিক্রেতা/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেছেন।

রাসেল জানান, গ্রাহকদের অর্ডার করা পণ্যের মধ্যে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পণ্য ইভ্যালি নিজস্ব গুদাম থেকে কয়েকটি ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের (তৃতীয় পক্ষ) মাধ্যমে সরবরাহ করত। এছাড়া সিংহভাগ পণ্যের অর্ডারের বিষয়ে ইভ্যালি বিক্রেতা/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দিত। সেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদনের পর সরাসরি ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিত। তাই গ্রাহকের পণ্য না পাওয়ার পেছনে সরবরাহকারী ও ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান দায়ী।

যে গলদের কারণে দিনের পর দিন ভোগান্তিতে পড়েন গ্রাহকরা

পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে, ইভ্যালি অর্ডার নেওয়ার পর পণ্য ডেলিভারির জন্য সরবরাহকারী ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দিত এবং ‘ধরে নিত’ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেটি ডেলিভারি হয়ে গেছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতা আদৌ ডেলিভারি করেছে কি না সেটি নিজ থেকে জানার উপায় ছিল না ইভ্যালির। আবার জানার চেষ্টাও করত না।

জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল পুলিশকে বলেন, ‘আমরা সিংহভাগ পণ্য সরবরাহকারী/বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে ডেলিভারির দায়িত্ব দিতাম। কোনো গ্রাহক যদি পণ্য না পেতেন তাহলে তারা আমাদের জানানোর আগ পর্যন্ত আমরা ধরে নিতাম যে পণ্য ডেলিভারি হয়ে গেছে।’ এটাকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক পতনের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে পুলিশ।

ইভ্যালি কি প্রতারণা করেছে?

ইভ্যালির বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান ও ধানমন্ডি থানার দুটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশ। উভয় থানার মামলায় তাদের ৩টি ধারায় অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ধারাগুলো হচ্ছে ৪২০, ৫০৬ ও ৪০৬। দণ্ডবিধির ৪২০ নম্বর ধারাটিতে প্রতারণা করে সম্পত্তি বা অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, ৪০৬ নম্বর ধারায় ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ এবং ৫০৬ নম্বর ধারায় ভিকটিমকে ‘হত্যা বা আঘাত করার ভয়ভীতি’ দেখানোর অপরাধের কথা বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, তাদের বিরুদ্ধে হুমকি বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ। তবে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ মিলেছে। এ দুই অভিযোগে শিগগিরই চার্জশিট জমা দেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন : ই-কমার্স : ভরসা নাকি ভয়?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার এসআই ওয়াহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রাসেল প্রতিশ্রুত সময়ে পণ্য না দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তার স্ত্রী তেমন কিছু বলতে পারেননি। ইভ্যালি সম্পর্কে তার তেমন কিছু জানা নেই। প্রতিষ্ঠানে তার পদ ‘চেয়ারম্যান’ হলেও এটি পরিবারসূত্রে পেয়েছেন তিনি। মামলার তদন্ত হয়েছে, যেহেতু এই মামলায় আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে, তাই আর্থিক বিষয়গুলোর তথ্য যাচাই করতে আদালত থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে।’

প্রতারকদের সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে : ডিএমপি

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইভ্যালিসহ অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে যারা প্রতারণা করে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করেছে তাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা হয়েছে। সর্বশেষ সোমবার কিউকমের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি মামলা হয়েছে। এই মামলাগুলোর তদন্ত চলমান আছে। যারা প্রতারণা করেছে এবং যারা সহযোগিতা করেছে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আশা করছি, তদন্ত শেষ করে কিছুদিনের মধ্যেই মামলাগুলোর চার্জশিট জমা দেবে পুলিশ।’

কবে চার্জশিট?

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে ইভ্যালির বিরুদ্ধে গুলশান থানার মামলাগুলোর চার্জশিট মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গেছে। আনুষঙ্গিক কিছু কাজ কেবল বাকি আছে। এগুলো গুছিয়ে আনা হলেই আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক ওয়াহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে সুনির্দষ্ট কিছু বলতে রাজি হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ইভ্যালির রাসেলসহ অন্যদের বিরুদ্ধে এই মাসেই অর্থাৎ অক্টোবর মাসের মধ্যেই চার্জশিট জমা দেওয়া হতে পারে। 

ইভ্যালির লেনদেনের নথি যাচাই করছে সিআইডি

ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণাসহ বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। তবে তারা মূলত অর্থ পাচারের বিষয়গুলোই তদন্ত করছে। সিআইডি জানায়, তাদের কাছে যেসব প্রতারণার মামলা এসেছে সেগুলোর তদন্তে যদি অর্থ পাচারের কোনো তথ্য পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে তারা মামলায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের নতুন ধারা সংযোজন করবে।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইভ্যালির মামলাগুলোর পাশাপাশি আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা তদন্ত করছি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে আমরা মামলা দায়ের করব।

ই-ক্যাবের সর্বশেষ অবস্থান

এদিকে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে ইভ্যালির সদস্যপদ স্থগিত করেছে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)।

ই-ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন বলেন, ইভ্যালি অনেক সময় নেওয়ার পরও ক্রেতাদের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। ই-ক্যাবের ওপর নির্দেশ ছিল ১৫ দিন পরপর তাদের অবস্থান জানান দেওয়ার। ইভ্যালি আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়নি। এছাড়া ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ প্রকাশিত হওয়ার পর ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করেনি, এমনকি ই-ক্যাবের অন্য সদস্যদের পাওনা পরিশোধের বিষয়ে সন্তোষজনক পদক্ষেপ নেয়নি। তাই তাদের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে।

ই-ক্যাবের জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম শোভন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইভ্যালির বিষয়ে এখন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। ইভ্যালির গ্রাহকদের টাকা পরিশোধের বিষয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিলে সেটি সমর্থন করবে ই-ক্যাব। ইভ্যালির এখন উচিত সরকারের কাছে তাদের পরিকল্পনা তুলে ধরা। কারণ সরকার কিন্তু ইভ্যালির ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করেনি।

এআর/একে/এসকেডি/জেএস