তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে ৩০টির অধিক উপায়ে তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে দেশীয় ও বহুজাতিক বিভিন্ন তামাক কোম্পানি। এতে শিশু-কিশোর ও তরুণরা ধূমপানে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং তামাকজনিত ক্ষয়-ক্ষতি ও মৃত্যুহার বাড়ছে। আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আইন লঙ্ঘনকারী তামাক কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের বর্তমান চিত্র এবং করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভার বক্তারা এসব কথা বলেন। সভাটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট, এইড ফাউন্ডেশন, গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি, জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি (নাটাব), টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) ও ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট।

মূল প্রবন্ধে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক একেএম মাকসুদ বলেন, বর্তমান সময়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে সর্বাধিক বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালাচ্ছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি। পাশাপাশি অন্যান্য তামাক কোম্পানিগুলোও প্রায় বিনা বাধায় তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাংলা, নাটাব, টিসিআরসি, ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট পরিচালিত ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় তামাকজাত দ্রব্যের মোট ৩১টি বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা কৌশল চিহ্নিত করা হয়েছে। ধোঁয়াবিহীন তামাক কোম্পানিগুলোও প্রচারণার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। 

নাটাবের প্রকল্প ব্যবস্থাপক একেএম খলিল উল্লাহ বলেন, তামাকবিরোধী আন্দোলনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশ ও মানুষের কল্যাণে সাংবাদিকরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে এ আন্দোলনকে আরও গতিশীল করতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তামাক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী প্রচারণা ও আইন লঙ্ঘনের চিত্রগুলো গণমাধ্যমে আরও অধিক হারে প্রকাশ করা জরুরি।

এইড ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প পরিচালক সাগুফতা সুলতানা বলেন, দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, বিধিমালা রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তামাকবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তারপরেও তামাক নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না এর অন্যতম প্রধান কারণ, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার। সরকারকে দ্রুত এ অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। টাস্কফোর্স কমিটিগুলো সক্রিয় করার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলোকে জরিমানার পাশাপাশি জেল প্রদান জরুরি।

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী বলেন, তামাকের বিজ্ঞাপন নয়, স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর প্রচার বাড়াতে হবে। তরুণদের তামাক বিমুখ করতে হলে তামাকের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংস্থাগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সরকারের কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করা জরুরি। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘লাইসেন্সিং ব্যবস্থা’ প্রবর্তনে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী হেলাল আহমেদ বলেন, মানুষের কাছে তামাক পণ্য সহজে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন তামাক কোম্পানি স্কুল-কলেজ, মার্কেট ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাজার হাজার ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন ও এসব স্থানে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। আইন অনুসারে এসব স্থান ধূমপানমুক্ত, কিন্তু আশেপাশে তামাকের দোকান আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে। আইন লঙ্ঘনে প্রকৃত অপরাধীরা পেছনে রয়ে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। সরকার প্রধানের কমিটমেন্ট রাখতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। 

টিসিআরসির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজা বলেন, তামাক পাতা দ্বারা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গল্প শুনিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে তামাক কোম্পানিগুলো। সিগারেট, বিড়িতে বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার, আকর্ষণীয় মোড়ক ও চটকদার বার্তা এবং জর্দা গুলের প্রচারণায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে কাজে লাগাচ্ছে কোম্পানিগুলো। তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর মুদ্রণের বিধি সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না। দেশে ই-সিগারেট জরুরিভাবে বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বাস্তবায়ন মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।

মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমান, সম্প্রীতি সোসাইটির কর্মকর্তা তুষার চন্দন, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের প্রোগ্রাম অফিসার শারমিন আক্তার, ডরপ এর মিডিয়া অফিসার আরিফ বিল্লাহ প্রমুখ।

এমএইচএন/আরএইচ