সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন ঘেষা বৈশখালী গ্রামে মাদার গাং নদীর চরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন রোমেছা বেগম (৩৫)। গেল ২৫ বছরে অন্তত ১৫ বার ঘরে পানি উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-উঠান ঠিক করে বছর না ঘুরতে আবার একই অবস্থা হয়ে যায়। তারপরও বাধ্য হয়ে মানিয়ে নিতে হচ্ছে এ ‘নিত্য অনাচারের’ সঙ্গে, নানা রোগ-শোক আর প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে কাটছে জীবন। 

সর্বনাশা বন্যায় ধসে যাওয়া বারান্দা ঠিক করতে করতে রোমেছা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন, ‘লোনা পানি আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। উঠোনে গাছ তো দূরে থাক, বছরের পর বছর ধরে দুটো ঘাসও জন্মায় না; এমন তেজ এই লোনা পানির।’

‘মাটির রাস্তা বলে বর্ষাকালে চলাচলে খুব কষ্ট। কিন্তু তারপরও আমরা বর্ষাকালের অপেক্ষোয় থাকি। কারণ, এ সময়ে বৃষ্টির পানিটা আমরা খেতে পারি। পুকুরের পানির লোনাও একটু কম থাকে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বেড়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। মাত্রাতিরিক্ত লোনা জমি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত তেমনি ভুগছেন এসব এলাকার জনগোষ্ঠীও। বিশেষ করে পানি গোসল থেকে শুরু করে দিনের যাবতীয় কাজে লোনা পানির ব্যবহারে নানা রোগে ভুগছেন উপকূলের নারী, কন্যা ও শিশুরা। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের সুবিধা থাকলেও শুষ্কমৌসুমে পানির জন্য হাহাকার চলে এসব এলাকায়।

খাবার সংগ্রহে সংগ্রাম করতে হয় এখানকার নারীদের

কয়েকবছর আগে অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেওয়া রোমেছা বেগম বললেন, ‘লোনা পানিতে নামলেই শরীর চুলকাতো। কিন্তু মিঠে পানি পাব কোথায়? এভাবে চলতে চলতে একসময় নিয়মিত রক্ত পড়তে থাকলো। পরে ডাক্তার জরায়ু অপারেশনের পরামর্শ দিলো। না খেয়ে টাকা জোগাড় করে অপারেশন করেছি।’

‘আমার মতো অবস্থা এই গ্রামের প্রায় সব মহিলাদের। এমন কোনো বাড়ি নেই, যে বাড়িতে জরায়ু কাটা রোগী নেই’।
রোমেছার কথার সত্যতাও মেলে। তারই পাশের বাড়ির ফিরোজা বেগম মাত্র ২৬ বছর বয়সে জরায়ু হারান। এ ছাড়াও লিউকোরিয়া, চুলকানিসহ নানা রোগে ভুগছেন এসব এলাকার নারী ও শিশুরা।

স্ত্রী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ও শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন রীতা রানী পাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অতিরিক্ত লোনাপানি থেকে যৌনপথে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। এরপর চুলকানি, জ্বালাপোড়া, সাদাস্রাব বা লিউকোরিয়া, অনিয়মিত বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে থাকে।’

শ্যামনগর উপজেলার ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কয়েকবছর ধরে জরায়ু অপারেশন বেড়েছে। অবশ্য এর পেছনে কত চিকিৎসা, কতটা দুর্নীতি তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে জরায়ু আক্রান্তের সংখ্যা যে বাড়ছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই বলে জানান তারা।

নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, কিন্তু জীবন যুদ্ধে উপকূলের নারীদের দুঃখ শেষ হয় না...

২০১৮ সালে ‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততার প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় লবণ পানিতে ধুয়ে আবারও সেটি ব্যবহার করে। এর ফলে নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয় তারা।

লোনা পানির কারণে নারীদের গর্ভপাত হয় বলেও আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে।

এদিকে ক্ষতিকর হলেও নারীদের জীবিকার জন্য নির্ভর করতে হয় লোনা পানির উপরেই। ভারত-বাংলাদেশকে বিভক্তকারী কালিন্দী নদীর পাড়েই কৈখালী ইউনিয়ন। সেখানকার বাসিন্দা হাসিনা বেগম দিনে ছয় ঘণ্টা ধরে কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে নদীতে মাছের পোনা ধরেন।

তিনি জানান, লোনা পানিতে দীর্ঘসময় ধরে থাকার পরিণামে প্রতি মাসে অপরিমিত রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। সংসার টেকাতে এই লোনা পানিই ভরসা।

‘আগে জমিতে ধান হতো। গরু, হাঁস, মুরগি পুষতাম। এখন সে উপায় নেই। কারণ, জমিতে ধান হয় না। নিজেরাই খেতে পারিনা। খড় কিনে গরুকে খাওয়ানোর উপায় কই!’ -বলেন হাসিনা।

‘ঘূর্ণিঝড় আইলার থেকে শুরু করে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় এসেছে সবগুলোতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বারবার লোনা পানিতে ডুবে গেছে ফসলের ক্ষেত থেকে ঘরবাড়ি। আগে খেতে দিনমজুরি করলেও এখন সেসব কাজও নেই গ্রামে। তাই ইট ভাটায় কাজ করতে গ্রাম ছেড়েছে স্বামী’ -বলেন এই জলবায়ু যোদ্ধা নারী।

লোনা পানির তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়ে পড়েছে খাবার পানি সংগ্রহ করা। অন্তত তিন থেকে চার মাস ধরে বৃষ্টির পানি খাওয়া সম্ভব হয় বর্ষাকালটা তাদরে জন্য আশীর্বাদ। অবস্থাসম্পন্ন গৃহে আধুনিক ট্যাংকিতে সংগ্রহ করে রাখা হয় পানি, যা দিয়ে বছরজুড়ে খাবার পানির সংকট মেটানো যায়। তবে বিপাকে পড়ে গরীব মানুষজন।

শুষ্ক মৌসুমে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সরবরাহ করা পানির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় তাদের। কোনো আয় না থাকলেও প্রতি লিটারে ন্যূনতম ৫০ পয়সা দরে পানি কিনে খেতে হয় বলে জানান এসব এলাকার মানুষ। কোথাও কোথাও এক লিটার পানির দাম ৭০ পয়সা পর্যন্তও হয়।

এই পানি সংগ্রহের কাজ বেশিরভাগই করেন নারীরা। কয়রা উপজেলার কয়রা ইউনিয়নের বাসিন্দা সুমতি মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পরিবারে ছয়জন মানুষ। গরমকালে পানির চাহিদা অনেক। আমাকেই প্রতিদিন অন্তত চার কলস পানি নিয়ে আসতে হয় দুই কিলোমটিার দূর থেকে। এ্ পানি পেতে আবার টাকাও দিতে হয়।

‘সুজলা সুফলা গ্রাম বলতে যা বুঝি তেমনই ছিল আমাদের গ্রাম। কিন্তু আইলার পর থেকে তা কার্যত মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। লোনা পানি ঢুকে জমিতে ফসল হয় না। বাধ্য হয়ে জমিগুলো ঘেরে পরিণত হয়েছে। অল্প জমি যাদের তারা কম পয়সায় বর্গা দিতে বাধ্য। ফলে কারো ঘরে আর ফসল ওঠে না’ -বলছিলেন গাবুরার ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল বারী।  

‘চাল, ডাল, পানি থেকে শুরু করে সব কিছু কিনে খেতে হয়। এমনকি জ্বালানিটা পর্যন্ত’ -বলেন তিনি।

এসব বিষয়ে কৈখালী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।’

‘প্রত্যেক ইউনিয়নে জলববায়ু তহবিল গঠনে বরাদ্দ দেওয়াসহ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সুপেয় পানির সংকট নিরসনে আরও পানির প্লান্ট তৈরি করতে হবে। আমরা এসব বিষয়ে বারবার সরকারের দৃষ্টি আহবান করছি’ -বলেন তিনি।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরীক্ষা করে দেখা যায়, উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর-কালিগঞ্জে ২০০-২৫০ ফুট গভীর পানির স্তর থাকলেও তা অনেক লোনা। এরপর আবার ১১০০ ফুট পর্যন্ত কোনো পানির স্তর নেই।’

কোথাও কোথাও ৬০০-৭০০ ফুট গভীরে সুপেয় পানি পাওয়া গেলেও সাধারণ পরিবারের জন্য এত গভীর নলকূপ বসানো কষ্টসাধ্য। শুধু বাংলাদেশের উপকূলেই নয় লোনা পানির সীমানার মতো ভারতের উপকূলেও ছুঁয়ে গেছে এর ভয়াবহতার মাত্রা।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালি, মিনাখাঁ, হিঙ্গলগঞ্জে গ্রামগুলোতে নিয়মিত মেডিক্যাল ক্যাম্প করেন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শ্যামল চক্রবর্তী। 

তিনি জানান, এসব গ্রামে অনেক জরায়ু সংক্রমণের রোগী মেলে। এরজন্য শুধু পরিচ্ছন্নতার অভাবই নয়, লোনা পানিও অন্যতম কারণ। এখানকার পানিতে লিটারে প্রায় ২০ গ্রাম লবণ রয়েছে। এই হাইপারটনিক স্যালাইন যোনিপথের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়, সংক্রমণ সহজে ছড়ায়।’

এসএম