নাম আব্দুল মুত্তালিব চিশতি। ভক্তরা চেনেন ‘পীর চিশতি’ নামে। দেশজুড়ে উরস আর মাহফিল করে জুটিয়েছেন হাজারও মুরিদ। উরসে তার পরনে থাকে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। কখনও পরেন মুজিব কোট, মাথায় লম্বা টুপি। আত্মার প্রশান্তিতে তোলেন জিকিরের হিড়িক। সেই হিড়িকে সাদা কাফনের কাপড় পরে অংশ নেন মুরিদ নর-নারীরা। বয়ানের পাশাপাশি পীরের লম্বা মোনাজাতে পাগল হন তারা!

লোক দেখানো এসব কর্মকাণ্ডের আড়ালে আব্দুল মুত্তালিবের চোখ থাকে শিকারের সন্ধানে। খুঁজে ফেরেন গে অ্যাক্টিভিজমের প্যাসিভ পার্টনার। পীরবাদ, চিশতিয়া ত্বরিকাকে যৌন হয়রানি আর ব্যবসার কৌশল হিসেব ব্যবহার করেন পীর চিশতি।

শুধু তা-ই নয়, সরকারি চাকরি আর স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থিতা বা সরকারদলীয় আওয়ামী লীগের হয়ে নৌকা প্রতীক পাইয়ে দেওয়ার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। গত নয় বছর ধরে চলে তার এমন প্রতারণা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়েন গোয়েন্দা পুলিশের জালে।

কখনও পরেন মুজিব কোট, মাথায় লম্বা টুপি। আত্মার প্রশান্তিতে তোলেন জিকিরের হিড়িক। লোক দেখানো এসব কর্মকাণ্ডের আড়ালে আব্দুল মুত্তালিবের চোখ থাকে শিকারের সন্ধানে। খুঁজে ফেরেন গে অ্যাক্টিভিজমের প্যাসিভ পার্টনার। পীরবাদ, চিশতিয়া ত্বরিকাকে যৌন হয়রানি আর ব্যবসার কৌশল হিসেব ব্যবহার করেন তিনি

গতকাল সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর তুরাগ থানা এলাকার একটি বাসা থেকে হাতেনাতে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিএমপি (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, কথিত এ ভণ্ড পীর গে অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে সক্রিয়। তার রয়েছে ‘গে কমিউনিটি’ পেজ। দুই বউ আর অসংখ্য মুরিদ থাকতেও তিনি পরিচালনা করতেন ‘ঢাকা গে কমিউনিটি’ (Dhaka Gay Community) নামের দুটি ওয়েব পেজ। এর মাধ্যমে প্রায় ১০০ বয় ফ্রেন্ডের (Boy Friend) সঙ্গে চালাতেন অস্বাভাবিক ও বিকৃত যৌনাচার। যার তথ্যপ্রমাণ রয়েছে ডিবি পুলিশের হাতে।

আব্দুল মুত্তালিব চিশতি ওরফে পীর চিশতি। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা / ছবি- সংগৃহীত

রাজনীতিকে প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভণ্ড পীর আব্দুল মোত্তালেব চিশতি তৈরি করেন আওয়ামী নির্মাণ শ্রমিক লীগ। বাগিয়ে নেন সিনিয়র সহ-সভাপতি পদও। এটি ব্যবহার করে ভক্তদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।

পীর চিশতির উরসের ভিডিও ফুটেজ এসেছে ঢাকা পোস্টের কাছে। সেখানে দেখা যায়, উরসের রঙিন জলসায় আব্দুল মুত্তালিব চিশতিকে ঘিরে চলছে জিকির-আসগার। পরনে তার ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। মাথায় লম্বা টুপি। মুরিদদের মুখে, সুরে-সুরে পীর চিশতির বন্দনা। এ যেন একবিংশ শতাব্দীর লালসালুর অবতারণা!

রাজনীতিকে প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভণ্ড পীর আব্দুল মোত্তালেব চিশতি তৈরি করেন আওয়ামী নির্মাণ শ্রমিক লীগ। বাগিয়ে নেন সিনিয়র সহ-সভাপতি পদও। এটি ব্যবহার করে ভক্তদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা

গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উরস মাহফিলের আয়োজন করতেন তিনি। এভাবে তৈরি করেন হাজারও মুরিদ-আশেকান। পরে সুযোগ বুঝে সরকারদলীয় প্রতীক নৌকায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া অথবা সরকারি ফ্ল্যাট-প্লট পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। গত নয় বছরে হাজারও ভক্ত-মুরিদের কাছ থেকে এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।

সারাদেশে হাজারও ভক্ত-মুরিদ আছেন ভণ্ড এ পীর চিশতির / ছবি- সংগৃহীত  

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ, উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সপ্তাহান্তে তার বাসায় বসে উরস মাহফিল। যেখানে জিকিরের হিড়িক পড়ে ভক্ত নর-নারীদের মাঝে। অংশ নেওয়া সবাই আসেন কাফনের সাদা কাপড় পরে। লম্বা বয়ানে মুগ্ধতা ছড়ান তিনি। ভক্ত-আশেকানদের মধ্যে আবেগে মূর্ছনা ছড়ানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ভক্ত-মুরিদরা অশ্রু বিসর্জন দিলেও আব্দুল মুত্তালিব থাকেন সুযোগের সন্ধানে, চোখ তার ঘুরেফিরে শিকারের খোঁজে।

মশিউর রহমানের দাবি, পবিত্র কোরআনের সর্বসাকুল্যে তিনটি সুরা জানা এ কথিত পীর আব্দুল মোত্তালিবের জন্য পীরবাদ ও চিশতিয়া ত্বরিকা যৌন হয়রানি আর ব্যবসার একটা কৌশল মাত্র।

ডিবি উত্তরের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ধান্দাবাজি আর প্রতারণায় রাজনীতিকে ব্যবহারের দৌড়েও বেশ এগিয়ে তিনি। ইতোমধ্যে একটি চক্রকে নিয়ে ভণ্ড এ পীর বানিয়েছেন আওয়ামী নির্মাণ শ্রমিক লীগ। বাগিয়ে নিয়েছেন সিনিয়র সহ-সভাপতি পদ। এ পদ ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তুলেছেন সেলফি ও ছবি। তাদের দিয়ে সুপারিশ করিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। বিশেষ করে শিক্ষা, ভূমি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে।

দুই বউ থাকলেও ‘ঢাকা গে কমিউনিটি’ নামের দুটি ওয়েব পেজ চালান তিনি / ছবি- সংগৃহীত  

মূলত যেসব মন্ত্রণালয় সারা দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মকাণ্ড চালায়, সেসব মন্ত্রণালয়ে তার আনাগোনা থাকে বেশি। কখনও মন্ত্রী, কখনও-বা সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো ব্যবহার করেন ক্ষমতা বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে। একদিকে পীরবাদের বয়ান, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার জন্য সফর করেন দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। এসব সফরে পীরবাদ ও রাজনৈতিক পদবি ব্যবহার করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে মাস্টার রোলে চাকরি দেওয়া, রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট স্বল্প মূল্যে বরাদ্দ দেওয়া, দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর অথবা মেয়র প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক পাইয়ে দেওয়ার নামে একেকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ছয় থেকে ১০ লাখ টাকা।

মশিউর রহমান বলেন, অভিযানে তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ‘ঢাকা গে কমিউনিটি’ নামের দুটি ওয়েব পেজ চালাতেন তিনি। পেজ দুটির মাধ্যমে প্রায় ১০০ বয় ফ্রেন্ডের (প্রেমিক) সঙ্গে চালাতেন অস্বাভাবিক ও বিকৃত যৌনাচার। ভণ্ড এ পীরের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। শতাধিক প্রতারিত ভুক্তভোগী লোকচক্ষু ও লজ্জায় অভিযোগ করতে সাহস দেখাচ্ছেন না।

গ্রেফতারের পর ভণ্ড পীর চিশতিকে মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ঢাকা মহানগর বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন— জানান এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

ধান্দাবাজি আর প্রতারণায় রাজনীতিকে ব্যবহারের দৌড়েও বেশ এগিয়ে ভণ্ড পীর চিশতি / ছবি- সংগৃহীত  

আব্দুল মুত্তালিব চিশতির প্রতারণার শিকার এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি নিজেও তার মুরিদ ছিলাম। উরসে যাওয়া-আসার মাঝে একদিন তার সঙ্গে সরাসরি কথা হয়। তিনি জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন। বিশ্বাস করে তার সঙ্গে এক ভাতিজার চাকরির জন্য আট লাখ টাকার চুক্তি করি। অগ্রিম দিই পাঁচ লাখ টাকা। অন্যদিকে, উত্তরা দিয়াবাড়িতে সরকারি একটি ফ্ল্যাট পাইয়ে দেওয়ার জন্য আরও পাঁচ লাখ টাকা অগ্রিম দিই। কিন্তু তিনি কোনোটাই দিতে পারেননি। উল্টো আমাদের সব টাকাই তিনি আত্মসাৎ করেন।’

ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে অপকর্ম করলে কেউই রেহাই পাবে না— এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে ডিবি-উত্তরের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর রশীদ বলেন, ‘ধর্মীয় লেবাস ধারণ করে, মুজিব কোর্ট পরে প্রতারণা করেছেন দর্জি মনির থেকে শুরু করে অনেক প্রতারক। আমরা তাদের গ্রেফতার করেছি। সাধারণ মানুষ আবেগে পড়ে, না জেনে-বুঝে, অনৈতিকভাবে বিশ্বাস করে টাকা লেনদেন করেন। সবার প্রতি অনুরোধ, একইসঙ্গে সতর্ক করছি; কোনো অনৈতিক লেনদেন করবেন না। এমন প্রতারণায় ভুক্তভোগীরাও দায় এড়াতে পারেন না।’

জেইউ/এমএআর/