২২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০টিই কাগুজে ও অস্তিত্বহীন। যাদের কোনো অফিস নেই। সরেজমিন পরিদর্শনে দুই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পাওয়া গেলেও সেগুলোও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। আবার ঋণ নেওয়া ওইসব নামধারী প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও দেশে-বিদেশে পলাতক। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের নামে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে লুটপাট হয়েছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা।

জয়েন্ট স্টকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে পিকে হালদার সিন্ডিকেট ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স নিয়ে ওই অর্থ আত্মসাতের সুযোগ পেয়েছে কি না সে বিষয়ে খতিয়ে দেখতে খোঁজখবর নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যে কারণে যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতরের কাছে পিকে হালদারের লুটপাট সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেয়ে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সংস্থাটির উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।

চিঠিতে যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে তা হলো- আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস, লিপরো ইন্টারন্যাশনাল, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড ও ওকায়ামা লিমিটেডের দাখিলকৃত আবেদনের কপি এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রেকর্ডপত্রাদি, অডিট প্রতিবেদন, বার্ষিক প্রতিবেদন, ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট ও ইনকাম স্টেটমেন্ট, এজিএম ও কোম্পানি ফাংশন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রসহ উক্ত কোম্পানির প্রথম নিবন্ধন থেকে শুরু করে সর্বশেষ নিবন্ধন পর্যন্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র।

জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেই চলে। ফলে ঋণের টাকা আদায়ের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এ অপকর্মের পেছনের কারিগর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার।

অস্তিত্বহীন ২০ প্রতিষ্ঠান হলো- নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, এসএ এন্টারপ্রাইজ, সুখাদা প্রপার্টিজ লিমিটেড, নেচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, উইনটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, বর্ণ, সদ্বীপ কর্পোরেশন, আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে, অ্যান্ডবি ট্রেডিং, আরবি এন্টারপ্রাইজ, দেয়া শিপিং লিমিটেড, ইমার এন্টারপ্রাইজ, জি অ্যান্ড জি এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, মেরিনট্রাস্ট লিমিটেড, মুন এন্টারপ্রাইজ, এমটিবি মেরিন লিমিটেড এবং পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।

জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেই চলে। ফলে ঋণের টাকা আদায়ের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এ অপকর্মের পেছনের কারিগর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। 

লুটপাটে নেতৃত্ব দানকারী পিকে হালদার, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক ও সাবেক সচিব মো. আতাহারুল ইসলাম, পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী এবং ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডিসহ ৭৫ জনকে আসামি করে ২০ মামলার অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। শিগগিরই কমিশনের অনুমোদনক্রমে মামলাগুলো দায়ের করা হবে বলে জানা গেছে।

এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকের লেয়ারিং সংক্রান্ত তথ্যের জন্য ২০টি ব্যাংকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছে কি না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে তলব করা হতে পারে বলেও জানা গেছে।

দুদকের অনুসন্ধানে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া পিকে হালদারের ২২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০টি কাগুজে ও অস্তিত্বহীন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০ প্রতিষ্ঠানকে বর্ণিত ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। ২ টি প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া গেলেও সেগুলো বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে এফএএস ফাইন্যান্সের সহকারী ম্যানেজার মো. নুরুল আমিনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি টিম দুই সপ্তাহ সরেজমিনে পরিদর্শন করেও ২০টি প্রতিষ্ঠানকে বর্ণিত ঠিকানায় খুঁজে পায়নি। ঋণ নেওয়া ওই সব প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও তাদের বাসায় থাকেন না বা বিদেশে পলাতক রয়েছেন। সবার মোবাইল নম্বরও বন্ধ রয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধান কাজের তদারককারী কর্মকর্তা ও দুদক পরিচালক বেনজীর আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাজ অনুসন্ধান করে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা। অনুসন্ধান কাজ চলছে। মামলা হলে জনসংযোগ দফতরের মাধ্যমে তা জানতে পারবেন।

অন্যদিকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের কাছে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, পিকে হালদার ইস্যুতে আমাদের টিম ১৫টি মামলা করেছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এর বাইরে জানতে হলে আমাদের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

দুদকের অনুসন্ধানে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া পিকে হালদারের ২২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০টি কাগুজে ও অস্তিত্বহীন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০ প্রতিষ্ঠানকে বর্ণিত ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। ২টি প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া গেলেও সেগুলো বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে এফএএস ফাইন্যান্সের সহকারী ম্যানেজার মো. নুরুল আমিনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি টিম দুই সপ্তাহ সরেজমিনে পরিদর্শন করেও ২০টি প্রতিষ্ঠানকে বর্ণিত ঠিকানায় খুঁজে পায়নি। ঋণ নেওয়া ওই সব প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও তাদের বাসায় থাকেন না বা বিদেশে পলাতক রয়েছেন। সবার মোবাইল নম্বরও বন্ধ রয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক সূত্রে আরো জানা যায়, ২০১৪ সালের শেষের দিকে পিকে হালদার সিন্ডিকেট এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। কৌশলে পুরাতন কর্মচারীদের ছাঁটাই করে তাদের পছন্দ মতো কর্মচারী নিয়োগ প্রদান করা হয়। রাসেল শাহরিয়ারকে এমডি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। রাসেল শাহরিয়ার পিকে হালদারের পূর্ব পরিচিত। ২০০৭ সালে তারা একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মূলত উজ্জ্বল কুমার নন্দী তার পছন্দ মতো পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগ দেন।

প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের রহস্য উদ্ঘাটনে প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ২২ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ পরিচালকরা ঋণ অনুমোদনে তাদের অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন এবং এজন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

সিদ্দিকুর রহমান এবং জাহাঙ্গীর আলম হলেন পিকে হালদারের বন্ধু এবং ব্যবসায়িক পার্টনার। সে সুবাদে এফএএস ফাইন্যান্সের দায়িত্ব পড়ে সিদ্দিক ও জাহাঙ্গীরের হাতে। অস্তিত্বহীন কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে হবে এ সিদ্ধান্ত আগেই পিকে হালদার দিয়ে দিতেন। লোক দেখানো বোর্ড মিটিং হতো এবং বোর্ডে এমডিকে ডেকে বলে দেওয়া হতো ‘দ্রুত ঋণের ব্যবস্থা করো’। আর রাসেল শাহরিয়ার অস্তিত্ব যাচাই ছাড়াই এবং কোনো মর্টগেজ না নিয়ে ক্রেডিট মেমো প্রস্তুত করে বোর্ডে উপস্থাপন করে ঋণ অনুমোদন করে নিতেন। উক্ত ঋণের প্রকৃত মালিক পলাতক রয়েছেন এবং ঋণের বিপরীতে কোন প্রকার মর্টগেজ নেই। তাই ঋণের অর্থ আদায় করা অনিশ্চিত হবে মর্মে বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের রহস্য উদ্ঘাটনে প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ২২ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ পরিচালকরা ঋণ অনুমোদনে তাদের অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন এবং এজন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, পিকে হালদার প্রায়ই এমডি রাসেল শাহরিয়ারের কক্ষে আসতেন এবং বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। যদিও পিকে হালদার ওই প্রতিষ্ঠানের কেউ ছিলেন না।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল।

অন্যদিকে দুদক ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতে এখন পর্যন্ত ১৫টি মামলা করেছে। এসব মামলায় আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ১১০০ কোটি। এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জন আদালতে নিজেদের দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আরএম/এসকেডি/জেএস