চিকিৎসকরা কেন রাজনীতি করবে এমন প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় সংসদে। বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে এই আলোচনার সূত্রপাত করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। পরে এই আলোচনায় যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে।

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিএনপি করে গিয়েছিল ড্যাব, আওয়ামী লীগ এসে করেছে স্বাচিপ। সেক্ষেত্রে আমরা কী কারণে বসে থাকছি? ডাক্তাররা যদি এই দেশে রাজনীতি করে তাহলে আমরা কী করব? আমাদের কাজটা কী? ওনারা চলে আসুক রাজনীতি করতে। যারা ভালো ছাত্র তারা ডাক্তারি পড়ে, কিন্তু তারা যদি রাজনীতি করে তাহলে আমরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছি।

বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে বেহাল দশা, গত বছর থেকে আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে যত কথা বলছি এই একটি সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদে যে বিলটি এনেছেন সেটি অপ্রয়োজনীয়। স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ে আমার কী লক্ষ্য, উদ্দেশ্য। আমি স্বাস্থ্য বিভাগের কী সংস্কার করতে চাই, স্বাস্থ্য বিভাগের সংকট দূর করার জন্য কী করার দরকার? দেশের পঞ্চশ বছর অতিক্রম করেছি। আমরা এখনো পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারিনি। যারা আজকে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত তারাই আজকে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসা করছে।

তিনি বলেন, এতগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, মাননীয় মন্ত্রী কি বলতে পারবেন এইগুলো মানসম্মত? আজকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে যারা শিক্ষা অর্জন করছে তারা কয়জন বিসিএসে টিকছে? আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইছি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে এই ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? যেসব ছাত্ররা, অভিভাবকরা অনিয়ম করে সেখানে ভর্তি হয়েছে, যারা চিকিৎসা বিজ্ঞানে জ্ঞান অর্জন করবে, সে ব্যাপারে সরকার বলেছিল এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সিআইডি রিপোর্ট দিচ্ছে এখানে লাগাতারভাবে ৭ বছর অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে।

বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, দেশ যায় কোনদিকে, মানুষের সমস্যা যায় কোনদিকে, মানুষ কোন বিষয় নিয়ে সাফার করছে, আর আমরা আলোচনা করছি কী? অদ্ভুত লাগে। করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে কতগুলো পরিবার পঙ্গু হয়ে গেছে সেই খবর কী আমাদের কাছে আছে? করোনাকালে হাতেগোনা কিছু রিপোর্ট আসছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, করোনায় সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। 

তিনি বলেন, অনেকে প্রাণে হয়তো বেঁচে গেছে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। জমানো টাকা শেষ হওয়া থেকে শুরু করে বিরাট ঋণের জালে আটকা পড়েছে বহু মানুষ। আমাদের সোশ্যাল স্ট্রাকচার চেঞ্জ হয়ে গেছে। করোনার আগে যেখানে মধ্যবিত্ত ছিল ৭০ শতাংশ সেখানে মধ্যবিত্ত নেমে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। দরিদ্র মানুষ যেখানে ছিল ২০ শতাংশ সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ। করোনাকাল বলে হয়তো এ ব্যাপারে মিডিয়ার কিছুটা মনযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি মেডিকেলে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ইতিহাস কিন্তু নতুন কিছু নয়। 

বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, করোনাকালে যে কয়টি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে মানুষকে সর্বস্বান্ত করার অভিযোগ আসছে তার মধ্যে সব থেকে শীর্ষ আছে বলতে কষ্ট লাগে সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্যের হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ। এই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সরকার ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতে তার কর্মীদের হাতে এমনভাবে তুলে দিচ্ছে যে চট্টগ্রামে সিআরবি নামে যে জায়গাটি আছে, যেটিকে চট্টগ্রামের অক্সিজেন বলা হয় সেটাও নাকি এখন বেসরকারি হাসপাতাল করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হবে। রেলওয়ের জায়গা বলতে তো কিছু নেই সবই রাষ্ট্রীয় জায়গা, এই রাষ্ট্রীয় জায়গা বেসরকারি খাতে তুলে দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। 

বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মোশারফ হোসেন বলেন, চিকিৎসকরা রাজনীতি করছেন। আমরা রাজনীতি করি রাজনীতিবিদের জায়গায় থাকব। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আইন-শৃঙ্খলার জায়গায় থাকবে। ডাক্তাররা ডাক্তারদের জায়গায় থাকবে। সেই জায়গাগুলোকে রিপেয়ার করা দরকার। বেসরকারি হাসপাতালগুলো তারা কিছু যেভাবে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে টাকা রোজগারের একটি পথ খুলে নিয়েছে সেখানে মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। 

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, অ্যাডমিন ক্যাডারের লোক বা পুলিশ ক্যাডারের লোক তারা তো চাকরি করে প্রাইভ্টে কোনো বিষয়ে কনসালটেন্সি তারা করতে পারবেন না। ডাক্তাররা কেন বিসিএস অফিসার হয়ে তার ডিউটির পর যদি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে, সেক্ষেত্রে তার যে মূল কাজ সেটা ঠিক থাকে না। এটা দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা। আমি মাননীয় মন্ত্রীকে বলব যদি উপকার করতে চান তাহলে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসটা আপনারা দয়া করে বন্ধ করার চেষ্টা করেন। জনগণের পয়সা দিয়ে তাদের বেতন দেবেন, তারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন এটা আমরা করতে পারি না। 

তিনি বলেন, আমরা দেখি ঢাকা শহরে ইউনাইটেড, ল্যাবএইড এসব হাসপাতাল ডাকাত। এইখানে দেখা যায় যখন মানুষ চিকিৎসা করতে যায় তখন দেখা যায় এক লাখ, দুই লাখ, দশ লাখ টাকা বিল করে তাদেরকে আটকে রাখে। মাননীয় মন্ত্রী আপনি একটা কমিটি করে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার জন্য একটা রেট করে দেন। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তার বক্তব্যে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা দেশের প্রতিটি কলেজে মেডিকেল কলেজ হবে। সেটা পর্যায়ক্রমে হবে। সেই অনুযায়ী ৩৮টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে সব জেলায় হয়ে হবে।
 
মন্ত্রী বলেন, ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। স্বাচিপ, বিএমএ রয়েছে। রাজনীতিতো সবাই করতে পারে। প্রকৌশলী, আইনজীবীরা রাজনীতি করতে পারে। সেই অনুযায়ী চিকিৎসকরা যদি তাদের অ্যাসোসিয়েশন করলে, তাতে কোনো দোষ বা অন্যায় দেখি না। তারা তো সেবা দিচ্ছে। 

তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনার সেবা দিয়েছে। সেখানকার চিকিৎসা ফি নির্ধারণে আমরা বৈঠক করছি। আশাকরি সেটার সমাধান হবে। 

মন্ত্রী বলেন, বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। আর বিমানবন্দর জায়গা দেবে। আমরা শুধু কারিগরি সহযোগিতা দেব। আমরা শুনেছি দু'একদিনের মধ্যে বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হবে।

এইউএ/জেডএস