র‍্যাবের অভিযানে আটক লিটন ও তার সহযোগী আজাদ

রাজধানীর একটি হাসপাতালে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি করতেন লিটন মিয়া। সেখানে অনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে তিনি ইরাকে গিয়ে হয়ে যান ডা. লিটন। আর এ পরিচয় কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন মানবপাচার চক্র।

বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত নার্সদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিত হয়ে কাউকে বিয়ের ও কাউকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ইরাকে নিয়ে যেতেন লিটন। আর সেখানে তাদের নির্দিষ্ট কোনো কাজ না দিয়ে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রি করে দিতেন।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে ইরাক থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় শনিবার অভিযান চালিয়ে লিটন মিয়া ওরফে ডা. লিটন (৪৪) ও তার সহযোগী আজাদ রহমান খানকে (৬৫) আটক করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট, জাল টাকা, চেকবই, ইয়াবা, বিয়ার ও একটি প্রাইভেটকার জব্দ করে র‍্যাব-৪।

শনিবার বিকেলে কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, লিটন ইতোমধ্যে ২০০-২৫০ জন মানুষকে ইরাকে পাচার করেছেন। তাদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন নারীও রয়েছেন। লিটন ও তার সহযোগীরা টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই নিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে ভিজিট ভিসায় ইরাকে নিয়ে আটকে রাখেন নিজেদের কথিত সেফ হাউজে। তরুণদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করে দেশে স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করতেন তারা। আর নারীদের ১৩ থেকে ১৫ হাজার দেরহামের বিনিময়ে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে বিক্রি করে দিতেন।

তিনি আরও বলেন, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি হারিয়ে লিটন ২০১৩ সালে ইরাকে গিয়ে সবার কাছে নিজেকে ডা. লিটন বলে পরিচয় দিতে থাকেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বাগদাদের একটি হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন বলে প্রচার করতেন। আর নারীদের টার্গেট করে বাগদাদে চাকরির প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএইচসি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে নার্সদের অনেক চাহিদা রয়েছে। আর লিটন যেহেতু আগে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন, সে কারণেই তার এ সেক্টরের বিষয়ে ধারণা ছিল। এজন্য পাচারের জন্য তিনি নার্সদের টার্গেট করতেন। যে নার্সদের বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা থাকতো, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি সখ্যতা গড়ে তুলতেন।

তিনি আরও বলেন, ইরাকের স্বনামধন্য হাসপাতালে মোটা বেতনে চাকরির প্রলোভন, আবার কখনো নিজে বিয়ে করবেন বলে নার্সদের নিয়ে যেতেন। এরপর সেখানে আটকে রেখে সুবিধামতো সময়ে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে বিক্রি করে দিতেন। এর বাইরে অন্য নারীদের বিভিন্ন সুপার শপ, বিউটি পার্লারে চাকরির কথা বলেও পাচার করা হতো। 

র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, অন্তত ছয়টি বিয়ে করা লিটন নিজেকে অবিবাহিত বলে পরিচয় দিতেন। বেশিরভাগ বিয়েগুলোই তিনি করেছেন টেলিফোনে। যে ছয়জনকে বিয়ে করেছেন, তার মধ্যে পাঁচজনকেই পাচার করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। চক্রের মূলহোতা লিটন। চক্রে দেশে ১০-১৫ জন এবং ইরাকে আরও পাঁচ থেকে সাতজন রয়েছেন বলে জানা গেছে। ইরাকে তাদের ছয় থেকে সাতটি সেফহাউজ রয়েছে, যেখানে পাচারকৃতদের নিয়ে আটকে রাখা হতো।

দুজন ভুক্তভোগীর বরাত দিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, তাদের একজনকে বিয়ে করে এবং আরেকজনকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৯ সালে ইরাকে নিয়ে যান লিটন। এর মধ্যে একজন গিয়ে একটি সেফ হাউজে ৪০-৫০ জনকে দেখেছেন। যেখানে ১৫-২০ জন নারী রয়েছেন। একজন কৌশলে পালিয়ে একটি হাসপাতালে তিন মাস চাকরি করেন, এরপর দেশে ফিরে আসেন। আরেকজনকে মোট তিনবার বিভিন্ন দালালের কাছে বিক্রি করা হয়। সর্বশেষ যার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল, তার সহায়তায় তিনি প্রায় দুই বছর পর দেশে ফেরেন।

মানবপাচারের দায়ে লিটন দুবার ইরাকে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন। এরপর পালিয়ে ২০১৯ সালেই দেশে ফেরেন। আর সেদেশে যাননি তিনি। দেশে এসে তিনি বালুর ব্যবসাসহ অন্যান্য কাজ করছিলেন। দেশে তার নামে ছয় থেকে সাতটি মামলা থাকলেও এবারই প্রথম তিনি আটক হলেন।

ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স নিয়ে মানবপাচারে লিটনের সহযোগী আজাদ

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, আজাদ ১৯৯৩ সাল থেকে বিদেশে মানবসম্পদ রফতানির কাজ করছেন। তিনি এ পর্যন্ত ২৫-৩০ হাজার লোক বিদেশে পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। লিটনের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে ২০১৬ সাল থেকে তিনি চাকরির প্রলোভনে অন্তত ২০০-২৫০ জনকে পাচার করেছেন। পাচারদের কাউকেই তিনি চাকরি দিতে পারেননি। উল্টো সেখানে নিয়ে জিম্মি করে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছেন। মানবপাচার প্রক্রিয়ার জন্য ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন, ভিসার ব্যবস্থা ও টিকিট কাটাসহ যাবতীয় কাজ করতেন আজাদ।

এমএসি/আরএইচ