গতি কমানোর ভাবনা বিটিআরসির
বিকল্প পন্থা-নেটওয়ার্কে চলছে পাবজি-ফ্রি ফায়ার গেম
মিরপুরের উত্তর পীরেরবাগের মাইকের গলি। বিকেল হতেই নবনির্মিত একটি ভবনের নিচে বসেই চলছে মুঠোফোনে কিশোরদের ‘গেম’ খেলা। হাইকোর্টের নির্দেশনায় পাবজি ও ফ্রি ফায়ারের মতো ক্ষতিকারক গেম দুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এরপরও বিকল্প উপায়ে চলছে তাদের গেম খেলা।
স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র মিসবাহ (ছদ্মনাম) জানান, করোনার কারণে স্কুল এখনও বন্ধ। অধিকাংশ সময় ফ্রি থাকা এ শিক্ষার্থীও সহপাঠীদের পাল্লায় শিখেছেন পাবজি গেম খেলা।
ঢাকা পোস্টকে মিসবাহ বলেন, বন্ধের নির্দেশনা আসবে— এমন খবরেই আগে থেকে ভিপিএন ব্যবহারে গেমটি খেলছি। এটি একা নয়, দল বেঁধে খেলতে হয়। ভিপিএন ব্যবহারে প্রথম প্রথম সমস্যা হচ্ছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে। আগের মতোই খেলা যাচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্যে।
শিশুদের মনোবিকাশে বাধা ও উগ্র মানসিকতা তৈরি করে পাবজি ও ফ্রি ফায়ার গেম। সেজন্যই বন্ধ করাটা জরুরি ও সময়সাপেক্ষ ছিল। কিন্তু গেম দুটি পুরোপুরি বন্ধের সক্ষমতা বিটিআরসির নেই। যে কারণে বন্ধের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে
পাবজি গেমে আসক্ত তাসনিমের দাবি, ভিপিএন ছাড়াও পাবজি ও ফ্রি ফায়ারের রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল সার্ভার। যেটি ব্যবহারে যেকোনো দেশ থেকে খেলা যাচ্ছে গেম দুটি।
বিজ্ঞাপন
শুধু পীরেরবাগ নয়, রাজধানীর অনেক অলিগলি ও ভবনের ছাদে দেখা মেলে কিশোরদের দল বেঁধে পাবজি গেম খেলায় আসক্তির দৃশ্য। এসব কিশোরই করোনার আগে কোনো না কোনো স্কুলে পড়ছিল। স্কুল বন্ধ, আশেপাশে নেই খেলার কোনো মাঠ। এ সুযোগেই কিনা মোবাইল ফোনে গেম খেলায় আসক্তি তৈরি হয়েছে?
বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্যান্য ব্যাটেল রয়্যাল গেমের মতোই পাবজি কিংবা ফ্রি ফায়ার গেমও অনেক বেশি হিংস্র। এর ভয়াবহতাও অনেক বেশি। ব্যবহারকারী শিশু-কিশোরদের মধ্যে একপ্রকার ক্ষিপ্রতা তৈরি করে।
পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া কিংবা বিকল্প নেটওয়ার্কে (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন) অনলাইন গেম পাবজি ও ফ্রি ফায়ারের ব্যবহার চলায় ‘প্রাযুক্তিক ব্যর্থতা’ বলছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শিশুদের মনোবিকাশে বাধা ও উগ্র মানসিকতা তৈরি করে পাবজি ও ফ্রি ফায়ার গেম। সেজন্যই বন্ধ করাটা জরুরি ও সময়সাপেক্ষ ছিল। কিন্তু গেম দুটি পুরোপুরি বন্ধের সক্ষমতা বিটিআরসির নেই। যে কারণে বন্ধের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে ও প্রাযুক্তিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে জানা গেছে, প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে বাংলাদেশে এখনও বিভিন্ন স্থানে মোবাইল ফোন থেকে গেম দুটি খেলা যাচ্ছে। আবার ভিপিএন ব্যবহারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবহারকারীরাও গেম দুটি খেলতে পারছেন। তবে, বিটিআরসির কর্মকর্তারা বলছেন, গেম দুটির লোকাল সার্ভার থাকতে পারে। যার মাধ্যমে এখনও বাংলাদেশে গেম দুটি চলছে। ভিপিএন বন্ধ করা সম্ভব না। তবে গতি কমিয়ে দিয়ে গেম খেলা বিঘ্নিত করা যায় কিনা, সে চেষ্টা চলছে।
ভিপিএন ছাড়াও পাবজি ও ফ্রি ফায়ারের রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল সার্ভার। যেটি ব্যবহারে যেকোনো দেশ থেকে খেলা যাচ্ছে গেম দুটি
আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা আব্দুর রশিদ একটি সরকারি ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা। স্ত্রীও একটি বেসরকারি ব্যাংকে জব করেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ছে। দেড় বছর স্কুলছাড়া সন্তান দুটির দেখভাল করাটা অত্যন্ত কষ্টের। করোনায় ঘরবন্দী জীবনে প্রথম প্রথম বাচ্চাদের মোবাইল ফোনে সময় দেওয়াকে কিছু মনে করতাম না। এখন শুনছি ওরা পাবজি গেম খেলে। যে গেমের ভয়াবহতা সম্পর্কে নিজেও কিছুই জানতাম না। হাইকোর্টের নির্দেশনার পর পাবজি গেম সম্পর্কে জানতে পারি। কিন্তু দুই সন্তানই আসক্ত। গেম বন্ধের সিদ্ধান্তে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু ওরা এখনও দেখছি গেম দুটি খেলেই যাচ্ছে। নিষেধ করলে রাগ-অভিমান করছে। এসব দেখে নিজেকে খুবই অসহায় লাগছে।
গেল সপ্তাহে গেম দুটি বন্ধের খবর পাওয়ার পর কিছু সময় মোবাইলসহ সব ভার্সনে গেমের অ্যাপ দুটিতে ঢোকা যাচ্ছিল না। কিন্তু দিন পার না হতেই বিকল্প পন্থা হাজির।
মোবাইল অপারেটর কোম্পানির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, গেম দুটির মোবাইল ভার্সনের অপারেটিং সিস্টেম বেশ শক্তিশালী। বাংলাদেশে একটা ভার্সন বন্ধ করা গেলেও গ্লোবাল ভার্সনে গেম দুটি খেলা যাচ্ছে বাংলাদেশে বসেই। এরকম আরও ছয়টি ভার্সন আছে, যেগুলোও বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
পাবজি-ফ্রি ফায়ারে আসক্ত শিশু-কিশোরদের মধ্যে উগ্র মানসিকতা তৈরি হতে পারে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতিরিক্ত হিংস্রতা শিশু-কিশোরদের মধ্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরবর্তী জীবনে শিশুদের হিংস্র করে তুলতে পারে এ গেম। খুন করে হলেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার মানসিকতা তাদের মধ্যে তৈরি হতে পারে। আর যেকোনো বিষয়ে আসক্তির প্রভাব খুবই খারাপ। আলোচিত 'ব্লু হোয়েল' গেমের মতোই এ দুটি গেম শিশু-কিশোরদের পারিবারিক, সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত করতে পারে, ভায়োলেন্ট হয়ে যেতে পারে। মানসিক নানা রোগের কারণও হতে পারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুবিশেষজ্ঞ প্রফেসর রাজেশ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতিরিক্ত আসক্তি বা কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে বেশি সময় ধরে তাকিয়ে থাকার কারণে চোখের ক্ষতি হতে পারে। ঘুম বিঘ্নিত হতে পারে।
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিটিআরসির নির্দেশনা পাওয়ার পরই বাংলাদেশে পাবজি ও ফ্রি ফায়ার বন্ধ করেছেন। আমরা আমাদের সিস্টেম থেকে গেম দুটির অ্যাকসেস বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু গেম দুটির ব্যবহার বিকল্প পন্থায় চলছে বলে জেনেছি। লোকাল সার্ভার বন্ধ থাকলেও ভিপিএন ব্যবহারে চলছে। দেশে ভিপিএন বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করছি ভিপিএনের গতি কমিয়ে দিতে। যাতে গেম দুটির ব্যবহার বিঘ্নিত হয়।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক তানভীর হোসেন জোহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাবজি ও ফ্রি ফায়ার বুদ্ধিভিত্তিক গেম। এটা খেলতে হিউম্যান নেটওয়ার্ক গড়তে হয়। বাচ্চা-কিশোররা লোকাল নেটওয়ার্ক গড়ে পাবজি গেম খেলছে। এতে করে শিশু-কিশোরদের দ্বারা অনেক রকমের অপরাধ সংঘটিত বা অপরাধপ্রবণতা তৈরি হতে পারে।
বিটিআরসির ব্লক করা বা ট্রাফিক ব্লক করার সিস্টেমটি ওয়েববেইজড। যেকোনো ওয়েবপেইজ তারা বন্ধ করতে পারেন। কিন্তু ভিপিএন তারা বন্ধ করতে পারেন না বা সে সক্ষমতা তাদের এখনও হয়নি। এক্ষেত্রে পাবজি বা ফ্রি ফায়ার গেম ডাউনলোড করে লোকাল হোস্টেজে দেখতে হবে যে কোন কোন আইপি সক্রিয় বা কাজ করছে। সেগুলো ধরে ধরে বন্ধ করে দিতে হবে। তবেই এ দুটি গেম বন্ধ করা সম্ভব— মত দেন তিনি।
তবে, ভিপিএনের গতি কমানোর সঙ্গে একমত নন এ প্রযুক্তিবিদ। তিনি বলেন, এটা কোনো সমাধান নয়। কারণ, ভিপিএন ব্যবহারে অনেক প্রযুক্তি চলে দেশে। এতে অনেক রকমের সার্ভিস বন্ধ বা বাধাগ্রস্ত হবে। বরং চাইলে ভিপিএনভিত্তিক প্রযুক্তি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করতে পারে মন্ত্রণালয়। তখন দেশে ভিপিএনের অপব্যবহার চাইলেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
উল্লেখ্য, সব অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে অবিলম্বে পাবজি ও ফ্রি ফায়ারসহ ক্ষতিকর গেম বন্ধে গত ১৯ আগস্ট লিখিত আদেশ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। আদেশে তিন মাসের জন্য এসব গেম অনলাইনে বন্ধ রাখার কথা বলা হয়।
এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ আগস্ট সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পাবজি, ফ্রি ফায়ারসহ ক্ষতিকর গেম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে অনলাইন প্লাটফর্মে টিকটক, লাইকি, বিগো লাইভসহ ক্ষতিকর অ্যাপ এবং পাবজি ও ফ্রি ফায়ারসহ ক্ষতিকর গেম বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না— তা জানতে রুল জারি করেন আদালত।
জেইউ/এমএআর/