কেউ গার্মেন্টসকর্মী, কেউবা অটোরিকশা চালক। কেউ আবার ট্রাকচালক। তবে তাদের প্রত্যেকেই সংঘবদ্ধ গাড়ি ডাকাতির কাজে জড়িত চক্রের সদস্য। গত ৯ মাসে ৮টি বাসে যাত্রীবেশে উঠে যাত্রীদের মালামাল লুণ্ঠন করলেও গ্রেফতার হননি কেউ। কিছুদিন পরপরই তারা পরিকল্পিতভাবে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী বাসে ডাকাতি করে আসছিলেন। 

সম্প্রতি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ এলাকায় হানিফ পরিবহনের চালককে জিম্মি করে ডাকাতি, যাত্রীদের মালামাল লুণ্ঠন ও চালককে হত্যার ঘটনায় জড়িত সংঘবদ্ধ আন্তঃজেলা বাস ডাকাত চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)।

রোববার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। 

তিনি বলেন, গত ৩১ আগস্ট দিবাগত রাতে ঢাকা হতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া হানিফ পরিবহণের একটি বাস রংপুর জেলার পীরগঞ্জ এলাকায় পৌঁছার পর দুর্ধর্ষ ডাকাতির কবলে পড়ে। ওই বাসে যাত্রীবেশে থাকা ডাকাত দলের সদস্যদের ছুরিকাঘাতে বাসের চালক মনজুর হোসেন (৫৫) গুরুতর আহত হন এবং পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন।

ওই ঘটনায় বাসের সুপারভাইজার মো. পইমুল ইসলাম বাদী হয়ে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়। 

চাঞ্চল্যকর এ বাস ডাকাতি ও চালক হত্যার ঘটনায় র‍্যাব-১ ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে র‍্যাব-১ ও ১৩ এর যৌথ অভিযানে ঢাকার আশুলিয়া ও গাইবান্ধায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাসহ ডাকাতিকাজে সরাসরি জড়িত নয়ন চন্দ্র রায় (২২), মো. রিয়াজুল ইসলাম ওরফে লালু (২২), ওমর ফারুক (১৯), ফিরোজ কবির (২০) আবু সাঈদ মোল্লা (২৫) ও শাকিল মিয়াকে (২৬) গ্রেফতার করে। প্রত্যেকের বাড়ি গাইবান্ধা জেলায়। 

এ সময় তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ৫টি ছুরি, লুণ্ঠিত একটি মোবাইল ফোন এবং তাদের ব্যবহৃত ৫টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হানিফ বাসে ডাকাতি ও চালককে হত্যায় গ্রেফতাররা সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে দাবি র‍্যাবের।

যাত্রীবেশে হানিফ বাসে ওঠে ডাকাতরা

কমান্ডার খন্দকার কাল মঈন বলেন, গত ৩১ আগস্ট রাত ৮ টায় হানিফ পরিবহনের একটি নন-এসি বাস (ঢাকা মেট্রো-গ-১৫-৩৮১০) রাজধানী ঢাকা হতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে গাবতলী ছেড়ে যায়। বাসটি রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাভারে পৌছলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাকাত দলের তিন সদস্য রিয়াজুল ইসলাম লালু, সাঈদ মোল্লা ও পলাতক আরও এক সদস্য ওঠে। এরপর রাত ১০টা ৫০ মিনিটে নবীনগর থেকে ওঠে ডাকাত দলের আরও তিন সদস্য নয়ন চন্দ্র রায়, ওমর ফারুক ও ফিরোজ কবির। 

বাস নিয়ন্ত্রণে নিতে চালককে ছুরিকাঘাত 

বাসটি রাত আড়াইটার দিকে গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার বিটিসি মোড় অতিক্রম করার পর বাসে যাত্রীবেশে থাকা ডাকাত দলের সদস্যরা ডাকাতির উদ্দেশে বাসটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তারা প্রথমে বাসের চালক মনজুর হোসেনকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। এ সময় চালক বাসটি ঘুরিয়ে আনার চেষ্টা করলে তারা আবার চালকের কাঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেন। 

ডাকাত দলের সদস্য রিয়াজুল ইসলাম লালু বাসটি চালাতে থাকেন এবং ডাকাত দলের অন্যান্য সদস্যরা বাসে লুটপাট করতে করতে রংপুরের শটিবাড়ী ভাবনা ফিলিং স্টেশনে ইউটার্ন করে পুনরায় উল্টো পথে রওয়ানা করেন। পলাশবাড়ী পৌঁছার আগে ডাকাতেরা ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে পীরগঞ্জের চম্পাগঞ্জ হাইস্কুলের সামনে রাত ৩টার দিকে যাত্রীসহ বাসটি রেখে পালিয়ে যান।

এ সময় ডাকাতেরা যাত্রীদের মুঠোফোন এবং নগদ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে গুরুতর আহত অবস্থায় বাসের চালক মনজুর হোসেনকে পলাশবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে তিনি সেখানে মারা যান।

নয়ন চন্দ্রের পরিকল্পনায় বাসে ডাকাতি

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাব জানায়, গ্রেফতার সংঘবদ্ধ ডাকাত দলটির সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জন। নয়ন চন্দ্র রায় ডাকাত দলের মূলহোতা। তিনি এই ডাকাত দলটিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। দীর্ঘদিন ধরে উত্তরবঙ্গগামী বাসে সাধারণ যাত্রীবেশে উঠে ডাকাতি করে আসছিলেন তারা। গত বছর ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৭/৮টি বাসে ডাকাতি করেছেন বলে জানিয়েছেন তারা। 

ইতোপূর্বে চক্রটি পলাশবাড়ী থেকে পীরগঞ্জ ৪৮ কিলোমিটার এলাকা গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রত্না স্পেশাল, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি সটিবাড়ি স্পেশাল, ১২ জানুয়ারি সৈকত পরিবহন, ৮ মার্চ শ্যামলী পরিবহন, ৪ এপ্রিল জায়দা পরিবহন এবং ও ১৯ আগস্ট ডিপজল পরিবহনে ডাকাতি করেছে বলে স্বীকার করেছে। 

পলাশবাড়ি-পীরগঞ্জ ৪৮ কি.মি. নির্জন মহাসড়কে ডাকাতি 

কমান্ডার আল মঈন বলেন, পলাশবাড়ি হতে পীরগঞ্জ ৪৮ কি.মি. মহাসড়কের অধিকাংশ এলাকাই নির্জন। তাই ওই স্থানটিই ডাকাতির জন্য বেছে নেয় চক্রটি। ডাকাতি করার পর ধরা যাতে না পড়েন সেজন্য তারা পুনরায় আশুলিয়ায় ফিরে আসেন।

মূলহোতা নয়ন চন্দ্র রায়কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের সদস্যরা আশুলিয়ায় বিভিন্ন গার্মেন্টসে খণ্ডকালীন চাকরি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, অটোরিকশা চালক হিসেবে জড়িত। শাকিলসহ আরও কয়েকজন সদস্য গাইবান্ধার বিভিন্ন পেশায় জড়িত।

রিয়াজুল ইসলাম লালু পেশায় একজন ট্রাক চালক। তিনি তার অন্যান্য সহযোগীদের সঙ্গে বাস ডাকাতি করার সময় বাসের চালকের পরিবর্তে নিজে বাস চালিয়ে তাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতেন। শাকিল ডাকাতি স্থলে উপস্থিত থেকে তথ্য ও অন্যান্য সহায়তার কাজ করতেন। গ্রেফতার অন্য সদস্যরা সশরীরে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করতেন।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার আল মঈন বলেন, এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে আমরা চক্রটির সঙ্গে পরিবহনে জড়িত হেলপার, চালক বা সুপারভাইজাদের জড়িত থাকার তথ্য পাইনি।

জেইউ/এইচকে