বৈধতা না থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে করোনা টেস্ট, লোক নিয়োগ ও ক্যাম্প স্থাপনের অনুমতি ছিল না টিকেএস গ্রুপের। সেজন্য পরিকল্পিতভাবে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জাকিয়া পারভীনের সিল-স্বাক্ষর জাল করে, ভুয়া প্রজ্ঞাপন ও অনুমতিপত্র তৈরি করা হয়। এরপর তা ব্যবহার করে ঢাকা ও ঝালকাঠি জেলার উপজেলা কো-অর্ডিনেটর এবং ইউনিয়নের ফিল্ড অফিসার পদে কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) বলছে, টিকেএস নামক এ নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানটির স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত কোনো রকম সনদ ও অভিজ্ঞতা নেই। তারপরেও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ইতোপূর্বে গ্রেফতার সাবরিনার জেকেজি কিংবা প্রতারক সাহেদের রিজেন্টের মতোই অপকর্ম শুরু করেছিল তারা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাল অনুমোদনপত্র দেখিয়ে করোনা টেস্টের নামে পাঁচ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে টিকেএসের বিরুদ্ধে। প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যন ও এমডিসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি।

দুই গিদন টানা অভিযান চালিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা ও ঝালকাঠি থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- টিকেএসের চেয়ারম্যান আবুল হাসান তুষার, এমডি আব্দুল্লাহ আলামিন এবং মার্কেটিং ম্যানেজার মোহাম্মদ শাহিন মিয়া।

এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড ও ট্যাক্স সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের জাল নিয়োগপত্র জব্দ করা হয়।

ডিবি বলছে, চক্রের মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন সিআইবির (কেয়ার গিভার ইন্সটিটিউশন অব বাংলাদেশ) মার্কেটিং ম্যানেজার আব্দুল্লাহ আলামিন এবং আরেকজন আলফালাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক রিলেশনশিপ ম্যানেজার আবুল হোসেন তুষার। আগের স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতাকেই তারা এই অপকর্মে কাজে লাগানো শুরু করেছিল।

বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ও ডিবি-উত্তর) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, রাজধানীর আল-রাজি কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় ফ্লোরকে নিজেদের কার্যালয় সাজিয়ে গত ১১ জুলাই টিকেএস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিকেএস হেলথ কেয়ার সার্ভিস নামক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করা হয়। আবেদনে তারা দেশের আট বিভাগ, ৬৪ জেলা, ৪৯২ উপজেলা ও ৪ হাজার ৫৬২ ইউনিয়নে বিনামূল্যে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করার অনুমতি চায়। প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজার ১২৬ জন সম্মুখ যোদ্ধা এ কাজের জন্য প্রস্তুত আছে মর্মে আবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা স্বীকার করেছে, প্রতিষ্ঠানের বৈধতা ও প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্ব না থাকায় মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পাবে না বুঝতে পেরে তারা প্রতারণার আশ্রয় নেয়।

চক্রটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, প্রশাসন শাখা-১ অধিশাখার ১৯ জুলাই তারিখের স্বারক সম্পূর্ণ জালিয়াতি করে। এছাড়া তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব জাকিয়া পারভীনের স্বাক্ষর-সিল জালিয়াতি করে নিজেরাই বুথ স্থাপন, স্যাম্পল কালেকশন, লোক নিয়োগ ও ক্যাম্পাস স্থাপনের অনুমতি নিয়ে নেয়।

এই ভুয়া অনুমতিপত্রের মাধ্যমে প্রতারক চক্রটি ঢাকা ও ঝালকাঠি জেলার উপজেলা কো-অর্ডিনেটর ও ইউনিয়নের ফিল্ড অফিসার পদে কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়। স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত কোনো রকম সনদ ও অভিজ্ঞতা না থাকার পরেও শুধু প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয় তারা।

আব্দুল্লাহ আল আমিন ও আবুল হোসেন তুষার প্রাথমিকভাবে কোম্পানির প্রোফাইল বানানোর জন্য এক হাজার টাকা খরচ করে। এছাড়া বিভিন্ন লোগো সম্বলিত আবেদনপত্র প্রিন্টে এক হাজার টাকা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার জন্য ২০০ টাকাসহ মোট আড়াই হাজার টাকা বিনিয়োগ করে সমগ্র বাংলাদেশে ১০০টি ক্যাম্পাস স্থাপন করে। প্রতিটি ক্যাম্পাসের ডিলারশিপ দেওয়ার জন্য তারা কমপক্ষে দুই লাখ টাকা করে মোট দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করেছিল।

একই সঙ্গে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ শিক্ষাবর্ষের এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন ছাত্র ও যুবককে ১০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশনের নামে আরও কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন বলেন, এর আগেও প্রতারক সাবরিনা ও সাহেদদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। সুতরাং আমরা জানাতে চাই, কেউ প্রতারিত হবেন না। কোথাও টাকা দেওয়ার আগে যাচাই করুন।

এক প্রশ্নের জবাবে এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। আইজিপির স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যারাই করোনা পরিস্থিতিকে অপব্যবহার করে জাল-জালিয়াতি বা প্রতারণার চেষ্টা করবেন তাদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

জেইউ/ওএফ/জেএস