লিজিংয়ের দুই কর্তার জবানবন্দি
এজেন্ট কমিশনের নামেও লোপাট ৬৪ কোটি টাকা!
হাজার কোটি টাকা ডিপোজিটের নামে লুটপাটে অংশ নিয়েছিলেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের সাবেক দুই এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান ও রাশেদুল ইসলাম।
শুধু তাই নয়, ডিপোজিট সংগ্রহের পুরস্কার হিসেবেও বিভিন্ন এজেন্টকে দিয়েছেন ৬৪ কোটি টাকা। মাত্র তিন বছরে কমিশনের ওই টাকা নামে-বেনামে বিভিন্ন এজেন্টের নামে ছাড় করা হয়।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে নিজেই দোষ স্বীকার এসব তথ্য দেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস সাবেক এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জবানবন্দিতে আবেদ হাসান জানান, ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ডিপোজিট সংগ্রহ করার কমিশন হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। চেকে তার এবং সাবেক এমডি রাশেদুল হকের সই ছিল। সেখানে এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন নুর মোহাম্মদ, রাসেল ও রাজ্জাক নামে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা।
আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান ও সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী রিমান্ডের তৃতীয় দিনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। গত ১৬ মার্চ তাদেরকে গ্রেফতার করে দুদক। গ্রেফতারের পর তাদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আদালত তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাঁচ দিনের রিমান্ডে তিন দিন জিজ্ঞাসাবাদ করার পরই আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজি হন। এর বাইরে আমার কোনো বক্তব্য নেই।
সৈয়দ আবেদ হাসান ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে জানান, ২০০৩ সালে তিনি আইআইডিএফসিতে একাউন্ট অফিসার হিসেবে চাকুরী যোগদান করেন। তখন আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার তার সহকর্মী ছিলেন।
২০১৬ সালে তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে পি কে হালদারের সরাসরি সহায়তায় সে প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। একই বছরের অক্টোবরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদ তাকে এ প্রতিষ্ঠানের সিএফও হিসেবে নিয়োগ দেন।
মূলত প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে সব সদস্য ছিলেন পি কে হালদার সিন্ডিকেটের সদস্য। পি কে হালদারের নির্দেশেই বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ভিজিট প্রতিবেদন ছাড়াই এবং অনেকক্ষেত্রে কোন মর্টগেজ না নিয়ে ব্যাংকিং রীতি নীতির বাইরে এমডি রাশেদুল হক, এভিপি আল মামুন সোহাগ, সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী, কোম্পানির সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান ঋণ প্রস্তাব তৈরির পর ইন্টারনাল মেমোতে সই দেন।
অনুমোদনের পর ঋণের অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে না পাঠিয়ে পি কে হালদারের মৌখিক নিদের্শে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে পাঠান তারা। একই প্রক্রিয়ায় আনান কেমিক্যাল লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানকে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়।
জবানবন্দিতে আবেদ আরও জানান, একই প্রক্রিয়ায় পি কে হালদারের নির্দেশে লিপরো ইস্টারন্যাশনালের নামীয় অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ১৬টি চেকের মাধ্যমে ১১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪১ হাজার ৮৯৭ টাকা দেন তিনিসহ রাশেদুল হক, ভিপি নাহিদা রুনাই ও ম্যানেজার অভীক সিনহাস। যা প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির হিসাবে পাঠানো হয়েছে।
রাফসান রিয়াদ চৌধুরীর জবানবন্দি
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী তার জবানবন্দিতে জানান, তিনি ২০১০ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তখন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন পি কে হালদার। ২০১৫ সালে রাশেদুল হক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের এমডি হলে ওই বছরের জুন মাসে সে প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন রাফসান রিয়াদ।
প্রথমে রুনাইয়ের অধীনে ও পরে করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগে কাজ করেন রাফসান রিয়াদ চৌধুরী। তিনি জানান, ঋণের প্রস্তাবে মোট তিন থেকে পাঁচজনের সই লাগত। এর ওপর ভিত্তি করে বোর্ড মেমো হতো।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে যোগ দেওয়ার পর তিনি দেখেছেন, পি কে হালদার প্রতি সপ্তাহে তাদের অফিসে আসতেন। এমডি রাশেদুল হকের রুমে বসে হালদার বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করতেন। বেশিরভাগ ঋণের ক্ষেত্রে পি কে হালদার বিভিন্ন অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিকদের এনআইডি, ট্রেড লাইসেন্স, ঋণ প্রস্তাব, টিন সার্টিফিকেট এবং সিআইবি রিপোর্ট ব্যবহার করতেন।
রাফসান রিয়াদের জবানবন্দিতেও উঠে আসে আনান কেমিক্যাল লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানকে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণের বিষয়টি। পিকে হালদারসহ অন্যান্যরা বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির হিসাবে ঋণের অর্থ পাঠান।
একই প্রক্রিয়ায় কাগুজে প্রতিষ্ঠান দ্রিনান অ্যাপারেলস লিমিটেডের নামে জাল রেকর্ডপত্র তৈরি করে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু রাজীব মারুফ ও চেয়ারম্যান কাজী মমরেজ মাহমুদকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৬০ কোটি টাকা দেওয়া হয়।
কাগুজে প্রতিষ্ঠান কনিকা এন্টারপ্রাইজের নামে মালিক রামপ্রসাদ রায়কে ৬০ কোটি টাকা, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড নামের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ৬০ কোটি টাকা এবং শুকায়ামা লিমিটেডের নামে ৮৭ দশমিক ৬০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।
এসব ঋণের ইন্টারনাল মেমোতে রাফসান রিয়াদসহ এমডি রাশেদুল হক, এভিপি আল মামুন সোহাগ, কোম্পানির সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খানের সই ছিল। আর এসব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া ঋণের অর্থ পি কে হালদারসহ তার বিভিন্ন কোম্পানি ও বিভিন্ন ব্যক্তির হিসাবে পাঠানো হয়। এসব কারণে রাফসান রিয়াদ দুদকের দায়ের করা ৯ মামলার আসামি।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে সম্পদ রয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার মতো। ঘাটতি প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা আদায় করা অনেকটা অনিশ্চিত বলে জানা গেছে।
ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আলোচিত পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। এর কিছুদিন পর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ১৫টি মামলা করে দুদক। যার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভুয়া নামে ঋণ উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা এবং ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করে দুদক।
পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ১১ জন। যাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছাড়াও পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সর্বশেষ আবেদ ও রাফসানও জবানবন্দি দিলেন।
আরএম/আরএইচ/এমএআর