হোটেল ও অভিজাতপাড়ায় ইনডোর পার্টিতে রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার নজরুল ইসলাম রাজের নেতৃত্বে চলত মাদকের রমরমা বাণিজ্য। বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশি মদ কিনে নিজস্ব লোকজনের মাধ্যমে তা সরবরাহ করতেন তিনি। প্রযোজক রাজ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর নড়েচড়ে বসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।

সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বিদেশি মদ কেনাবেচায় জড়িতদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। তালিকায় চলচ্চিত্র পরিচালকসহ উঠে এসেছে ৩০ জনের নাম। যাদের নেতৃত্বে রাজধানীর অভিজাতপাড়ায় চলত মাদকের রমরমা বাণিজ্য। রয়েছে প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসান এবং শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসানের নামও।

এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল বলেন, আমরা তালিকা করেছি, প্রায়ই মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা হালনাগাদ করি। এবার বিশেষ করে বিনোদন জগতে মাদকের ব্যবসা, সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। শোবিজ জগতে কারা মাদক ব্যবসায় জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটি থেকে বহিষ্কৃত নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতারের পর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই গ্রেফতার হন মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ, চিত্রনায়িকা পরীমণি, তার ম্যানেজার মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম দিপু, তার কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ করিম জিমি, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, তার ম্যানেজার সবুজ আলী, মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসান, এবং শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান। তাদের বাসা ও অফিস থেকে বিদেশি মদ ও মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, পর্নোগ্রাফির বিভিন্ন কনটেন্ট জব্দ করার কথা জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, ও তার ম্যানেজার সবুজ আলীকে বনানীর বাসা থেকে গ্রেফতারের পর র‌্যাব জানায়, রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার নজরুল ইসলাম রাজের শোবিজ জগতে ক্যারিয়ার শুরু হয় ২০১৪ সালে। ২০১৪ সালের পর নাটক ও সিনেমা প্রযোজনা শুরু করেন। রাজ শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান এবং মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানের সহযোগিতায় ১০-১২ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। ওই সিন্ডিকেটটি গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টিতে মাদক সরবরাহ, মাদক সেবনসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করতেন। এ জন্য পার্টিতে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে নেওয়া হতো বিপুল পরিমাণ অর্থ।

শোবিজ জগতে রাজ-জিসান-মিশুদের মাদকের রমরমা ব্যবসা

শোবিজ জগতে রাজের উত্থানের মধ্য দিয়েই মাদকের রমরমা বাণিজ্য শুরু করে জিসান ও মিশু হাসান। তারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চবিত্ত প্রবাসীদের জন্যেও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টির আয়োজন করতেন। টাকার লোভে রাজ তার ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’ কার্যালয়কে অনৈতিক কাজে ব্যবহার করতেন। অভিযানে অনেকগুলো পর্নোগ্রাফির কনটেন্ট জব্দ করে র‌্যাব।

এ ব্যাপারে র‌্যাব সদর দফতরের র‍্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজের অবৈধ আয়ের বড় অংশ হচ্ছে মাদকের ব্যবসা ও প্রতারণা থেকে। সে অর্থ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় আমদানি, বালু ভরাট, ঠিকাদারি ও শোবিজ জগতে বিনিয়োগ করেছেন।

আরও পড়ুন : ৫ লাখ টাকা দিয়ে শুটিং ইউনিটকে উদ্ধার করেছিলেন পরীমণি!

তিনি বলেন, রাজের মাধ্যমেই একটি চক্র কাজ করছে বিনোদন জগতে। ওই চক্রে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে জিসান ও মিশু হাসানের। চক্রটি হোটেলে, অভিজাতপাড়ায় বিভিন্ন পার্টির আয়োজন করত। যেখানে মদের আসর বসত। আর রাজ নিজেই সেখানে মাদকের সরবরাহ করতেন। তার বাসায় বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার এটার সুস্পষ্ট প্রমাণ। মামলার তদন্তের দায়িত্বে এখন সিআইডি। আমরা যথাসম্ভব সিআইডিকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) উপ-পরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর আমরা শোবিজ জগতে মাদকের ব্যবসায় জড়িতদের একটি তালিকা তৈরি করেছি। সেখানে ২৫ থেকে ৩০ জনের নাম উঠে এসেছে। সে তালিকায় নতুন করে উঠে এসেছে একজন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালকের নামও। যুক্ত হয়েছে গ্রেফতার নজরুল ইসলাম রাজ, জিসান এবং মিশু হাসানের নামও। তিনজন এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। আমরা তদন্তের স্বার্থে তালিকায় থাকা সবার নাম প্রকাশ করছি না। পূর্ণাঙ্গ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, ৫ আগস্ট মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসান ও পিয়াসার বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলা, বনানী থানায় নজরুল ইসলাম রাজ ও সবুজ আলীর বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা, ভাটারা থানায় মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা, একই থানায় শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসানের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের মামলা এবং মাসুদুল ইসলাম জিসান ও শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসানের বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলার তদন্ত সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

আরও পড়ুন : আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি : পরীমণি

যোগাযোগ করা হলে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাছে আরও ছয়টি মামলার তদন্ত ভার হস্তান্তর করা হয়েছে। আগের মামলাগুলোর সঙ্গে এসব মামলার তদন্তেও যোগসূত্র খোঁজা হচ্ছে। বিশেষ করে মাদক মামলার আসামি রাজ, জিসান, মিশু হাসান ও পিয়াসাদের অর্থের উৎস, ব্যাংক স্টেটমেন্ট খতিয়ে দেখা হবে। তাদের সঙ্গে আর কেউ জড়িত কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জেইউ/এসকেডি