প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩১ জনের মৃত্যু তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। এ অবস্থায় বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নানা পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নামলেও এটি নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নগরবাসী।

এদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নিয়মিত চিরুনি অভিযানের কারণে আগের চেয়ে ডেঙ্গু রোগী কমছে বলে দাবি করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। গত বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) বিভিন্ন হাসপাতালে তিন শতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন। এদের অধিকাংশই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। একইভাবে বৃহস্পতিবারও ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে আরও ২৭০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর তাদেরও অধিকাংশই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা।

দুই বছর আগেও ডেঙ্গুর অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সে সময়ও ব্যাপকভাবে মাঠে নেমেছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ওই সময় ডেঙ্গু প্রতিরোধে কলকাতা ও সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তখন উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র কলকাতা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করে সেখানকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা বলেছিলেন।

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করে সেখানকার অভিজ্ঞতার আলোকে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে আলাদা দফতর স্থাপনের প্রস্তাব দেন। এসবের ভিত্তিতেই প্রকল্প তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, এরমধ্যে দক্ষিণ সিটির ডেঙ্গু প্রতিরোধ দফতর ‘কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট’ ও উত্তর সিটির ‘ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’ দুটি আলাদা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।

সেসময় দক্ষিণের পাঠানো প্রকল্প শুরুতেই আর আলো মুখ দেখেনি। কিন্তু উত্তর সিটির মেয়র দেশের কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটি ‘ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করে। এরপর প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ডিএনসিসি। সেটা নিয়ে এতদিন কাজ শুরু না হলেও গত বুধবার (১৮ আগস্ট) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, এডিস মশা নিধনে একটি ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী সারাদেশে কাজ শুরু হবে।

বুধবার উত্তর সিটি করপোরেশনের নগরভবনে আয়োজিত 'সুস্থতার জন্য সামাজিক আন্দোলন' শীর্ষক আলোচনা মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, এডিস মশা নিধনে একটি ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী সারাদেশে কাজ শুরু হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রয়েছে এবং প্রতিবছর প্রায় অনেক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়।

সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিফাইন, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর মশার প্রভাব বেশি একথা সত্য। কিন্তু আমরা কেউ বসে নেই, সবাই সর্বাত্মকভাবে যার যার অবস্থান থেকে নিরলসভাবে কাজ করছি আমরা।

জানা গেছে, ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্টের (আইভিএম) আওতায় থাকবে মশক নিধনের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, মশক নিধনকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, কীটনাশক প্রয়োগের পরে মশা, অন্যান্য কীটপতঙ্গ এবং সর্বোপরি পরিবেশের ওপর প্রভাব ইত্যাদি গবেষণা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ। এছাড়া হটস্পট নির্ধারণ, উৎপত্তিস্থল নির্ধারণ, প্রতি এলাকায় একযোগে মশার ওষুধের কার্যকারিতা নির্ধারণ, স্থানীয় কাউন্সিলর সহ প্রতিনিধি বা কমিটির মাধ্যমে সার্বিক বিষয় মনিটরিং, মশার ওষুধ যেন মশার জন্য সহনীয় না হয়ে যায় সেই লক্ষ্যে ওষুধ পরিবর্তন এগুলোর আওতায় থাকবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ডেঙ্গু ও এডিস নিয়ন্ত্রনে একটি আধুনিক গবেষণাগার তৈরি করার প্রস্তাব করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে একটি ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট স্ট্রাটেজি তৈরি করে সে অনুযায়ী কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্টের (আইভিএম) আওতায় বছরের ৩৬৫ দিন মশা নির্মূলে কাজ করবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসি সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিনই চলছে ব্যাপকভাবে অভিযান, যেখানে লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই জরিমানা করা হচ্ছে। ১৯ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন অঞ্চল  ১,২,৩,৪, ৫, ৬, ৭, ৮ ও ৯ এলাকায় ৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ৯৪০টি নির্মাণাধীন স্থাপনা ও বাসাবাড়িতে  অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ১৩টি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়। এ সময় মোট  ৮টি মামলায় ৪৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

১৮ আগস্ট নগরভবনে আয়োজিত সুস্থ্যতার জন্য সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কিত আলোচনা সভায় এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডেই জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে আমারা কাজ করে যাচ্ছি। অনেকে বাড়ির ছাদে ছাদ বাগান করেন, পরিত্যাক্ত কমোড ছাদে রেখে দিয়েছে। এগুলোতে জমে থাকা পানি ফেলে না দিলে যে সেখানেই এডিসের লার্ভা হয় এটা অনেকেই জানেন না। তাই আমারা প্রতিটি ওয়ার্ডে গিয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। শুধু আমরা চেষ্টা করলেই হবে না তাই সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। অভিযান পরিচালনা করার সময় নানা জায়গা থেকে ফোনে করে বলা হয়, জরিমানা করেন না, আমরা নিজ উদ্যোগে পরিস্কার করে দেব। আমারা কিন্তু চাইনা জরিমানা করতে, আপনারা সবাই সচেতন হলে আর জরিমানা কিন্তু করতে হবে না।

অন্যদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এডিসের লার্ভা ধ্বংসে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (রাজউক)। তাদের অভিযান প্রসঙ্গে রাজউক পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) প্রকৌশলী মো. মোবারক হোসেন জানিয়েছেন, এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ এবং নির্মাণ ব্যত্যয় তদারকি করতে রাজউকের আওতাধীন আটটি জোনে ৪টি ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ ১৯টি টিম পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তুলনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। দেশের সার্বিক করোনা এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে এ আশঙ্কার কথা জানান অধিদফতরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম।

তিনি বলেন, দেশে এই বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃত্যুর যে সংখ্যা আমরা রেকর্ড করেছি আমরা যদি রোগীর সংখ্যার দিকে তাকাই তাহলে রোগীর বিপরীতে এতো মানুষের মৃত্যু, এটি অত্যন্ত শঙ্কার কারণ।

নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, বর্ষাকাল এলে আমরা দেখি যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক অবস্থায় রূপ নেয়। গত ২০১৯ সালে আমরা দেখেছি যে একটি ডেঙ্গু মহামারি আমাদের কীভাবে আক্রান্ত করেছিল। ২০২১ সালে এসেও একই রকম একটি পরিস্থিতির মুখে আমরা দাঁড়িয়েছি। তবে আমরা মনে করি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সেটি মোকাবিলা করতে পারব।

এএসএস/এসএম