করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়ংকর হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ অবস্থায় বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নানা পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নেমেছে। তবু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নগরবাসী।

সিটি করপোরেশন বলছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। বিগত কয়েক বছরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা প্রকল্প, উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছিল। সে অনুযায়ী এ বছর দুই সিটি করপোরেশন মশক নিধন কাজে গুরুত্ব আগের চেয়ে বেশি দিচ্ছে। বাড়িয়েছে এ খাতের বরাদ্দও। এরপরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, জুলাই মাসে বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এই এক মাসে দুই হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আর তাদের ৯৯ শতাংশেরই বসবাস ঢাকায়। চলতি আগস্ট মাসেও এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বুধবার (১১ আগস্ট) নতুন করে ২১৩ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১৮৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নতুন করে ২৪২ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২১ জন এবং ঢাকার বাইরে ২১ জন।

এ নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৯৬ জন। এর মধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৮২৪ জন। অন্যান্য বিভাগে মোট ভর্তি রোগী সংখ্যা ৭২ জন।

রাজধানীতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দারা। মিরপুর পল্লবী এলাকার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল ওয়াদুদ বলেন, প্রতিদিনই খবরে দেখছি সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা কিছু করছে। কিন্তু বাস্তবে তো তাদের কার্যক্রম কিছুই দেখি না। মশার ওষুধ ছিটানো কোনো কর্মীকে তো আমারা দেখতে পাই না। যেহেতু ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল মশার ওষুধ আরও বেশি করে ছিটানো, কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো। কিন্তু আমরা মশক নিধন কর্মীকে খুঁজেও পাই না।

একই অভিযোগ রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা জুবায়ের আহমেদেরও। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে শুনলাম ঢাকার ১৭টি স্থান ডেঙ্গুর হটস্পট, এর মধ্যে বাড্ডাও ছিল। কিন্তু হটস্পট হওয়ার পরও এ কয়দিনে একবারও সিটি করপোরেশনের কাউকে এসে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখলাম না। সিটি করপোরেশনের কাজ কি শুধু হোল্ডিং ট্যাক্স নেওয়া? বাড়িতে ছোট বাচ্চা থাকায় দিনেও মশারি টাঙিয়ে থাকতে হয়। ডেঙ্গুর এমন প্রাদুর্ভাব দেখে ভয় বুক শুকিয়ে আসে। কিন্তু সিটি করপোরেশন থেকে আমার নাগরিক সেবার অংশ হিসেবে মশার যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাই না। এ অবস্থায় নাগরিকদের কথা ভেবে সিটি করপোরেশনের উচিত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এদিকে সিটি করপোরেশন বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা সার্বিক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সে অনুযায়ী এডিসের লার্ভা ধ্বংসে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাশার মোহম্মদ তাজুল ইসলাম উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিনই আমাদের অভিযান, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আজ (বৃহস্পতিবার) ডিএনসিসি এলাকায় এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তার রোধে মোবাইল কোর্টে ১৩টি মামলায় এক লাখ ৭৭ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। অভিযানের পাশাপাশি মাইকিং করে জনসচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা হয়। এছাড়া ‘তিন দিনে একদিন জমা পানি ফেলে দিন’ এ স্লোগান বার্তা প্রচার করা হচ্ছে।

গত ১০ আগস্ট এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে পরিচালিত সর্বশেষ চিরুনি অভিযান সংক্রান্ত তুলে ধরে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, গত ২৭ জুলাই থেকে গত ৯ আগস্ট পর্যন্ত উত্তর সিটিতে এক লাখ ১০ হাজার ৯১টি স্থাপনা পরিদর্শন করে ৯৬৩টি স্থাপনায় এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পরিচালিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ২৩৬টি মামলায় ৪৮ লাখ ৯৯ হাজার সাতশ টাকা জরিমানা আদায় এবং ২৮টি নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের জানিয়েছেন, এডিসের লার্ভা নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসি এলাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। বুধবারের অভিযানেও ডিএসসিসির ৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১২টি নির্মাণাধীন ভবন ও প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৭৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

অভিযান প্রসঙ্গে ডিএসসিসির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন বলেন, অঞ্চল ভিত্তিক অভিযানে আমাদের লোকবলকে মোট আটটি উপ-দলে বিভক্ত করে অভিযান পরিচালনা করেছি। সবাইকে বার্তা দিতে চাই, দয়া করে আপনারা আপনাদের ছাদ ও বেজমেন্টে নজর দিন। মশার লার্ভা জন্মাতে পারে এমন পরিবেশ বিরাজ করলে তবে সেসব উৎস ধ্বংস করুন। 

অন্যদিকে ডেঙ্গু লার্ভার উৎস নিধনে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার প্রজননস্থল সম্পর্কিত তথ্য দিতে হট লাইন নম্বর দিয়েছে সংস্থাটি। ডেঙ্গুর প্রজননস্থল সম্পর্কে ডিএসসিসিকে তথ্য দিতে ০১৭০৯৯০০৮৮৮ ও ০২৯৫৫৬০১৪ নম্বরে কল করতে বলা হয়েছে। 

তাছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলকাবাসীর নাগরিক সেবায় ‘সবার ঢাকা’ মোবাইল অ্যাপস, জরুরি সেবায় ৩৩৩ নম্বর এবং ডিএনসিসির ০৯৬০২২২২৩৩৩ ও ০৯৬০২২২২৩৩৪ নম্বর হটলাইন চালু রাখা হয়েছে। পাশাপাশি নগরবাসীর কল্যাণে উত্তর সিটির ৪৬টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই ডেঙ্গু রোগের ফ্রি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এএসএস/এসএসএইচ