যে কারণে তিনি বঙ্গমাতা
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান— এমন আলোচনা ঘুরেফিরে এসেছিল সত্তরের নির্বাচনে পর। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন, তা চাননি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব।
এমন বর্ণনা উঠে এসেছে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সরকার-দলীয় হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন রচিত ‘ছাব্বিশ সেল’ বইটিতে।
বিজ্ঞাপন
বইটির বর্ণনা অনুযায়ী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশে বঙ্গমাতা ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি কস্মিনকালেও (কোনো সময়ও) পিন্ডি যাব না।’ বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাইপ টানতে টানতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কৌতুক করে কবিতার লাইন আওড়াতেন। তিনি বলতেন, ‘ও দুটি চোখ চিরদিন মোরে হাসাল, কাঁদাল, চিরদিন দিল ফাঁকি।’ পান চিবুতে চিবুতে বঙ্গমাতা বলতেন, ‘ফাঁকি একটুও দেই নাই।’
সাদাসিধে সরল মানুষ ছিলেন তিনি। আমাদের বাঙালি নারীদের মতো অতিসাধারণ শাড়ি পরতেন। বিলাসী বসন ছিল না। পরিচিত-অপরিচিত যে কাউকেই আপন করে নিতে পারতেন। সম্মান, স্নেহ আর মমতা দিয়ে তিনি বঙ্গমাতা হয়ে উঠেছিলেন। আমি প্রথম যেদিন ওনাকে দেখেছিলাম, সেদিনই আমার মায়ের কথা মনে হয়েছিল
টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম নেওয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের হৃদয়ে ছিল বাঙালির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরিবারের দায়িত্বের পাশাপাশি দলের দরিদ্র রাজনৈতিক কর্মীদের সহায়তা করতেন তিনি। এমন স্মৃতির কথাই জানালেন দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্য ন্যাপের আহ্বায়ক পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, আমি যতদিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়েছি, এমন খুব কমই হয়েছে যেদিন আপ্যায়ন ছাড়া বের হতে পেরেছি। আমাকে প্রায়দিনই বলতেন, ‘ভাই এটা খান, ওটা খান। শরীরটা ঠিক রাখেন। আপনার ভাই তো শরীরের দিকে খেয়াল রাখেন না।’
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, সাদাসিধে সরল মানুষ ছিলেন তিনি। আমাদের বাঙালি নারীদের মতো অতিসাধারণ শাড়ি পরতেন। বিলাসী বসন ছিল না। পরিচিত-অপরিচিত যে কাউকেই আপন করে নিতে পারতেন। সম্মান, স্নেহ আর মমতা দিয়ে তিনি বঙ্গমাতা হয়ে উঠেছিলেন। আমি প্রথম যেদিন ওনাকে দেখেছিলাম, সেদিনই আমার মায়ের কথা মনে হয়েছিল।
মুজিবের সহধর্মিণী, যিনি রাজনীতি বুঝতেন না, কিন্তু নিজের স্বামীকে জানতেন। বুঝতে পেরেছিলেন তার স্বামীর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দি স্বামীকে খবর পাঠালেন, হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন, কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বরে আসবেন না
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের দৃঢ়তার আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায় প্রয়াত সাংবাদিক ও লেখক এ বি এম মূসার ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থে। ১৯৬৯ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে এ বি এম মূসা লেখেন, ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলছে। সাল ১৯৬৯। গণ-অভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গোল টেবিল বৈঠক ডাকলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে গোল টেবিল বৈঠক হয় কী করে? শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান বৈঠক সফল করতে রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বাধ্য হন কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানাতে।
তিনি লেখেন, কিন্তু দেশদ্রোহের দায়ে বিচারের আসামি, ক্যান্টনমেন্টে বন্দি, আসবেন কীভাবে? অবশেষে আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিলেন, প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হবে। ফেব্রুয়ারির ১৭ বা ১৮ তারিখ থেকে বিভিন্ন মহল শেখ সাহেবকে প্যারোলে যাওয়ার প্রস্তাব দিতে থাকেন। অনেকে জেলে দেখা করে তাকে একই অনুরোধ করেন। এদিকে, ঢাকায় তখন শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে কারফিউ ভেঙে রোজ রাতে মানুষের ঢল নামছে রাস্তায়।
এ বি এম মূসা লেখেন, ক্যান্টনমেন্টে বসে শেখ সাহেব কী ভাবছেন, কেউ তা জানে না। সারা দেশের মানুষও কিছুটা বিভ্রান্ত। তারা প্রাণ দিচ্ছেন, রক্ত দিচ্ছেন প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনার জন্য। মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন যিনি, তিনিও ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। সেদিন মুচলেকা দিয়ে, নাকি নিঃশর্ত মুক্তি নিয়ে তিনি রাওয়ালপিন্ডি যাবেন— সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একজন নারী। মুজিবের সহধর্মিণী, যিনি রাজনীতি বুঝতেন না, কিন্তু নিজের স্বামীকে জানতেন। বুঝতে পেরেছিলেন তার স্বামীর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দি স্বামীকে খবর পাঠালেন, ‘হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি, প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন, কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বরে আসবেন না।’
এতদিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো, কিছুই তো বলছ না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা কর; একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধা মতো যেকোনো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে
একাত্তরের উত্তাল মার্চে ইয়াহিয়া খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক খুব একটা ফলপ্রসূ হয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল না। এদিন সরকারের এক ঘোষণায় বলা হয়, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আরও বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কারণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু করার পূর্ব সিদ্ধান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করা হয়েছে। ওই সময় আভাস পাওয়া গিয়েছিল, ইয়াহিয়া খান কোনো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান করতে আন্তরিক ছিলেন না।
বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইতে বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, ওইদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘এতদিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো, কিছুই তো বলছ না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা কর; একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধা মতো যেকোনো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।’
ওয়াজেদ মিয়া লেখেন, কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বললেন, ‘আলোচনা এখনও চলছে। এ মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না।’ এ পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরের তলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলেন, কারও সঙ্গে কথাও বললেন না।’
এইউএ/এমএআর/