বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ নিত্যদিনের ঘটনা। যার ফলে পানির অবস্থা হয়েছিল বেহাল। তবে লকডাউন ও কঠোর বিধিনিষেধে সেই বেহাল দশা থেকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে রাজধানী ঢাকার প্রাণ ‘বুড়িগঙ্গা নদী’র পানি। বেড়েছে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ, পানিতে ঘোলাত্বের এবং পানিতে টোটাল ডিজলভ সলিডের (টিডিএস) মান হয়েছে সন্তোষজনক।

স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) প্রতিবছর শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশে নদীর পানির মান পর্যবেক্ষণ করে আসছে। ক্যাপসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২০ সালের এপ্রিলের তুলনায় চলতি বছরের আগস্ট মাসে বুড়িগঙ্গা নদীর পানির মান ভালো পাওয়া গেছে।

পানির মান নির্ণয় করার জন্য অন্যতম একটি নির্দেশক হচ্ছে, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন। বাংলাদেশে দ্রবীভূত অক্সিজেনের আদর্শ মান প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের গড় মান ছিল ১.৭ মিলিগ্রাম, ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ছিল ১.৮ মিলিগ্রাম এবং ২০২১ সালের আগস্ট মাসে পাওয়া গেছে ৪.২৬ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ গত ২ বছরের তুলনায় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান প্রায় ২ দশমিক ৫ গুণ ভালো পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বুড়িগঙ্গা নদীর পানির ঘোলাত্বের মানের বেশ উন্নতি হয়েছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে গড় ঘোলাত্বের পরিমাণ প্রতিলিটারে ৫ এনটিইউ (নেফেলোমেট্রিক টার্বিডিটি ইউনিট) পাওয়া গেছে। যা আদর্শমান ১০ এনটিইউ মধ্যে রয়েছে। কিন্তু বুড়িগঙ্গার পানিতে ২০১৯ ও ২০২০ উভয় সালে পানির ঘোলাত্বের মানও আদর্শ মানের চেয়ে প্রায় ১-৩ গুণ বেশি খারাপ ছিল। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার পানি গত ২ বছরের তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুণের বেশি পরিষ্কার হয়েছে।

এছাড়াও সার্বিকভাবে ৩টি পৃথক পর্যবেক্ষণে বুড়িগঙ্গা নদীতে গড় হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্বের (পিএইচ) মান বাংলাদেশের আদর্শ মানমাত্রার (৬.৫-৮.৫) মধ্যে ছিল। ২০২১ সালের পর্যবেক্ষণে সবকয়টি স্থানে পানিতে দ্রবীভূত বস্তুকণার (টিডিএস) উপস্থিতি কম দেখা গেলেও পুরাতন বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে ৬০০ পিপিএম পাওয়া যায়। যা এ বছরসহ গত ২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য যে, টিডিএসের আদর্শমান ১০০ পিপিএম। তবে টিডিএস ৬০০-৯০০ পিপিএম এর মধ্যে থাকলে সেটিকে সন্তোষজনক বলা হয়।

পর্যবেক্ষণে আরও দেখা গেছে, নদীর পানিতে গন্ধ নেই বললেই চলে। যে সব স্থানে পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশনের লাইন রয়েছে সেখানে আগের মতো দুর্গন্ধ অনুভব হয়, এমন একটি স্থান হলো আশরাফাবাদ পয়েন্ট থেকে কিছু পূর্বে। পরীক্ষায় দেখে গেছে, সেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রতিলিটার পানিতে মাত্র ২.৮ মিলিগ্রাম, পিএইচ মান ৯ অর্থাৎ পানিগুলো ক্ষারীয়। ধারণা করা হয়, বাসা বাড়ি থেকে আসা পানি বলে সেখানে সাবান ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতির কারণে পানি ক্ষারত্ব লাভ করে। এছাড়াও ওই স্থানে পানিতে ঘোলাত্ব ও ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি অন্যান্য স্থান থেকে বেশি পাওয়া যায়।

পর্যবেক্ষণে ধারণা করা হচ্ছে, সব মিলিয়ে ২০১৯ ও ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পানির মানের বেশ উন্নতি হয়েছে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, করোনাকাল হওয়াতে বেশিরভাগ শিল্প কারখানায় কাজের উৎপাদন কম ছিল এবং বর্ষাকাল হওয়াতে দূষণের পরিমাণ কম ছিল।

বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এ বছর কেমন দেখলেন— এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষক দলের প্রধান ও ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'করোনা মহামারির পাশাপাশি প্রতিবছর বিভিন্ন দূষণের কারণে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। শুধু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে তা নয়, দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে নদী, তেমনি একটি মৃতপ্রায় নদী বুড়িগঙ্গা। ঢাকার চারপাশে নদীগুলো একসময় ছিল ঢাকা সৌন্দর্যের কেন্দ্রভূমি। কিন্তু বর্তমানে দূষণের ফলে সৌন্দর্যের পাশাপাশি দূষণ হয়ে উঠছে স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ।’

তিনি আরও বলেন, 'নদী দখল যদি দূর করা যায় তাহলে দূষণ অনেকাংশে কমে আসবে। বর্তমানে লকডাউন এবং বর্ষা মৌসুমের কারণে নদীর পানির মান অর্থাৎ নদীর স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে যে সব পয়েন্টে বর্জ্য লাইন এসে মিলিত হয়েছে, সেসব পয়েন্টের মান আগের মতোই দেখা গেছে। এ বছর আমরা গবেষণায় দেখেছি, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ২ দশমিক ৫ গুন বেশি বেড়েছে এবং পানিতে মিশ্রিত লবণাক্ততার পরিমাণ আগের তুলনায় কমেছে। পানিতে ভাসমান বিভিন্ন ধরনের বস্তুকণার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় এ বছর কমেছে এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় পানির রং অনেকটা ভালো। অন্যদিকে অন্যান্য বছরের তুলনায় গন্ধের পরিমাণ কম ছিল।'

বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, নদী একটি জীবন্ত সত্তা এবং এর জন্য একজন অভিভাবক রয়েছে, যার নাম জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কিন্তু নদীর পানির স্বাস্থ্য দেখার মতো কেউ নাই। নদীর পানি দূষণের কারণে নদীতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। অথচ একটা সময় বুড়িগঙ্গা নদীর মাছ ধরে অনেক মানুষের সংসার চলত। আমি অনুরোধ করবো, সরকার যেন নদীর পানির মান রক্ষায় নজর দেয়। এছাড়াও ঢাকার চারপাশে পাঁচটি নদীকে রক্ষা করতে হবে। নদী পর্যবেক্ষণের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে এবং নদী রক্ষা আইনকে শক্তিশালী করতে হবে।

নদীর পানি কীভাবে ভালো করা যেতে পারে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাপসের গবেষণা পর্যবেক্ষণ প্রধান আব্দুল্লাহ আল নাঈম বলেন, বুড়িগঙ্গা নদীর পানির মান ভালো করার জন্য গবেষকদের ভূমিকা অপরিসীম। একইসঙ্গে সরকারের পূর্ণ সহায়তা এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে নদীর পানির মান ভালো করা সম্ভব। নদীর পানির মান ভালো করতে চাইলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা আর এর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অবশ্যই প্রয়োজন। ক্যাপসের মত পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাগুলো নদীমাতৃক দেশের নদীর পানির আয়তনের কাছে অতি নগণ্য।

নদীর পানির মান ভালো রাখতে সরকারের কাছে ৬টি সুপারিশ জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপস। সুপারিশগুলো হচ্ছে— নদী ও নদী পাড় থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা; শিল্প বর্জ্যের জন্য ETP/CETP ব্যবহার করা; ত্রুটিপূর্ণ নৌযান মেরামত ও নৌযানে পয়ঃপ্রণালীর আধুনিকায়ন করা; নদীতে পৌর বর্জ্য ছাড়ার পূর্বে স্ক্রিনিং পদ্ধতিতে কঠিন বর্জ্য অপসারণ করা; সিউয়েজ বর্জ্যের জন্য STP ব্যবহার করা এবং নদীতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা।

এমএইচএন/এসএম