রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতায় এখন পর্যন্ত ৮৩ ব্যক্তির প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা ফ্রিজ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সহায়তায় বিভিন্ন সময়ে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের ৩৯ কোম্পানির শতাধিক ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত ওই টাকা ফ্রিজ করা হয়। 

যেসব প্রতিষ্ঠানের নামের ঋণের টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে তা হলো- বিআর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, নেচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, হল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, আরবি এন্টারপ্রাইজ, আনান কেমিকেল, রিপটাইলস ফিল্ম লিমিটেড, পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল, আর্থস্কোপ লিমিটেড, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, কোলাসিন লিমিটেড, এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড, ওকায়ামা লি., জি অ্যান্ড বি এন্টারপ্রাইজ, ড্রিনুন অ্যাপারেলস লিমিটেড, মুন এন্টারপ্রাইজ, কনিকা এন্টারপ্রাইজ, সিগমা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, আইম্যাক্সকো, সুখাদা প্রোপার্টিজ লিমিটেড, সন্দ্বীপ কর্পোরেশন, উইনটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড,পদ্মা ওয়েভিং লিমিটেড, এমওএইচ ফ্যাশন লিমিটেড, এস এন্টারপ্রাইজ, শাদাত ট্রেডার্স, সাবির ট্রেডারস লি., গ্রিনলাইন ডেভলপমেন্ট লিমিটেড, মিসেস বর্নো, রহমান কেমিক্যালস লিমিটেড, ক্রসরোড কর্পোরেশন লিমিটেড, তামিম ও তালহা ব্রাদার্স লিমিটেড, ডিজাইন ও সোর্স লিমিটেড, জেডএ অ্যাপারেলস লিমিটেড, সুপিরিয়ার টেক্সটাইল লিমিটেড, নিথার্ন জুট  ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড সিমটেক্স টেক্সটাইল লিমিটেড এবং এমজে ট্রেডিং।

ফ্রিজ হওয়া হিসাবের মধ্যে নেচার এন্টারপ্রাইজ ও এমটিবি মেরিন লিমিটেডের মালিক নওশের উল ইসলাম নামে থাকা ৯৫২ কোটি টাকা রয়েছে। নওশের উল ইসলামের স্ত্রী মমতাজ বেগমের নামে থাকা ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকাও জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া এমটিবি মেরিন লিমিটেডের অপর মালিক বাসুদেব ব্যানার্জির নামে ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ও নেচার এন্টারপ্রাইজের মালিক পাপিয়া ব্যানার্জির নামে থাকা থাকা ৬১ লাখ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে।

এর মধ্যে নওশের উল ইসলাম, তার স্ত্রী মমতাজ বেগম, এমটিবি মেরিন লিমিটেডের অপর মালিক বাসুদেব ব্যানার্জি ও নেচার এন্টারপ্রাইজের মালিক পাপিয়া ব্যানার্জিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হলেও দুদকের ডাকে সাড়া দেননি তারা। তবে আলোচিত পি কে হালদার চক্রের প্রায় ৩৬০০ কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অর্ধশত কর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

দুদক সূত্রে জানা যায়, নওশের ইসলাম ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস লিজিং ও পিপলস লিজিং থেকে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কয়েক বছরে তার একাধিক হিসাবে জমা করেছেন ৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ২ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা তিনি তুলে নিয়েছেন। কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর দুদকের উদ্যোগে ৯৫২ কোটি টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে।  

পি কে হালদার একটি আলোচিত বিষয়। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও পর্যেবেক্ষণ রয়েছে। এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুদক উপপরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার

একইভাবে নওশের ইসলামের স্ত্রী মমতাজ বেগম ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে কয়েক বছরে তার একাধিক হিসাবে ৪ কোটি টাকা জমা করেন। যার মধ্যে ২.৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাত করা হয়েছে। তবে দুদক ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ফ্রিজ করেছে। 

অন্যদিকে বাসুদেব ব্যানার্জি ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে তার একাধিক ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন ৭৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে উত্তোলন করেছেন ৪৬২ কোটি টাকা। সেখান থেকে দুদকের অনুরোধে ফ্রিজ করা হয়েছে ৪.৬৪ কোটি টাকা। 

এ বিষয়ে দুদক উপপরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধানের স্বার্থে আমাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করতে হয়। পি কে হালদার একটি আলোচিত বিষয়। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও পর্যেবেক্ষণ রয়েছে। এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ঘটনায় বেশিরভাগই ঋণের ক্ষেত্রে মর্টগেজ ছিল না, থাকলেও তার পরিমাণ খুবই নগণ্য, কিছু ক্ষেত্রে মর্টগেজ নেওয়ার কথা থাকলেও পরে মর্টগেজ নেওয়া হয়নি। অথচ ঋণ হিসাব থেকে সব টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও মানিলন্ডারিংয়ে  শিগগিরই মামলা দায়ের করা হতে পারে।

অভিযোগ রয়েছে- পি কে হালদার ওই প্রতিষ্ঠানসহ পিপলস লিজিং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) দায়িত্ব পালন করে প্রায় ৩৬০০ কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচার করেছেন।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের পরপরই প্রশান্ত কুমার হালদারের নাম উঠে আসে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর হাজির হতে নোটিশ দিয়েছিল সংস্থাটি। তার আগে ৩ অক্টোবর তার বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ঠিকই দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। পিকে হালদারের প্রতারণায় সহায়তাকারী ২৪ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।

আরএম/এনএফ