যে কারণে সাইমন ড্রিং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু
ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের প্রয়াণে বাংলাদেশে শোকের কালো ছায়া নেমেছে। কারণ তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও নৃশংসতার সংবাদ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন সাইমন। স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছিল।
সাইমন ড্রিং ছিলেন সাহসী ও মেধাবী। বিবিসি ছাড়াও তিনি সাংবাদিকতা করেছেন রয়টার্স, টেলিগ্রাফ, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যমে। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ঢাকায় আসেন সাইমন ড্রিং। এর আগে ১৯৬৮ সালেও ঢাকায় এসেছিলেন বলেও জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
দ্বিতীয় দফায় একাত্তর সালে ঢাকায় আসার পরদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনেন সাইমন। মঞ্চের খুব কাছে ছিলেন তিনি। এরপর ঢাকায় অবস্থান করেন। এক পর্যায়ে ২৫ মার্চ সাইমন জানতে পারেন- পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান কোনো সমঝোতা ছাড়াই ঢাকা ত্যাগ করছেন।
সাইমন পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে থাকেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ঢাকায় ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে, যা তাকে দেখতে হবে। কোনো বড় ধরনের অঘটন ঘটবে বলে তার বিশ্বাস বেড়ে চলছিল। তখন ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের একত্রে রাখা হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তাদের গার্ড দেয় পাকিস্তানের সেনারা।
এরপর ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে দেয় পাকিস্তানের সৈন্যরা। রাতেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের মেজর সালেক সিদ্দিকী নিরাপত্তার অজুহাতে বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়। তবে ঢাকায় থেকে যান সাইমন। কৌশলে হোটেলের বাঙালি কর্মচারীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে হোটেলে লুকিয়েছিলেন তিনি। লুকিয়ে ৩২ ঘণ্টা কাটান।
হোটেলের লবি, ছাদ, বার ও রান্নাঘরে কাটে তার ৩২ ঘণ্টা। এরপর হোটেল ছেড়ে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (তখনকার ইকবাল হক) যান। নিজের চোখে দেখতে পান- ছাত্রদের মরদেহ। চারুকলায় গিয়ে তথ্য পান- সেখানেও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে চিত্র এবং তথ্য জোগাড় করেন সাইমন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনেও যান। দেখেন পাকিস্তানি সেনারা পতাকা উড়িয়ে রেখেছে। শত শত মরদেহ ট্রাকে তুলে নিচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখার একদিন পর ব্রিটিশ হাই কমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন তিনি। বিমানবন্দরে নাজেহাল হন। তাকে উলঙ্গ করে তল্লাশি করা হয়। তাকে ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। পায়ের মোজায় কাগজ লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেটা ধরা পড়ে। তার পায়ুপথে লাঠি প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করা হয়। তাকে পাকিস্তানের করাচিতে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়। সাইমন অবশ্য ব্যাংকক যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলেন।
পরে সাইমন ব্যাংককে যান এবং সেখান থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রতিবেদন পাঠান। শিরোনাম ছিল : ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ তা প্রকাশ পায়। সেবারই প্রথমবারের মতো সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার তথ্য প্রকাশ পায়।
প্রতিবেদনে সাইমন উল্লেখ করেছিলেন, আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরে অবশিষ্ট আর কিছু নেই।
স্বাধীনতার পর কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন সাইমন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর সাইমন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেদিন তার জন্মদিন হওয়ায় বঙ্গবন্ধু কেক কেটে জন্মদিন উদযাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
গত শুক্রবার (১৬ জুলাই) রোমানিয়ার একটি হাসপাতালে অন্ত্রে অস্ত্রোপচারের সময় সায়মন ড্রিংয়ের মৃত্যু হয়। তিনি রোমানিয়ার একটি নিভৃত পল্লীতে বাস করতেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে গেছেন।
পিএসডি/আরএইচ