গত এক বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগের পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে গরু পালন করেছেন খামারি আব্দুল জব্বার। লক্ষ্য ঈদুল আজহায় গরুগুলো বিক্রি করে কিছুটা লাভের মুখ দেখা। হাটে হাটে গরু নিয়ে যাচ্ছেন। তবে গরুগুলো বিক্রি হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তিনি।
 
গাইবান্ধার এ খামারি সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু আসা নিয়ে বেশ চিন্তিত! ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে গাইবান্ধা জেলা সদরের খামারি আব্দুল জব্বার বলেন, শুনছি সীমান্ত দিয়ে গরু আসছে। সত্যিই যদি আসে তাহলে আমরা বিপদে পড়ব। হয় লোকসানে গরু বিক্রি করতে হবে, না হয় খামারে গরুগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে।

শুধু আব্দুল জব্বার নন, তার মতো একাধিক খামারি এ প্রতিবেদকের কাছে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার দাবি জানান। তারা অনেকেই সীমান্ত পার হয়ে গরু আসার বিষয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। তবে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সীমান্ত দিয়ে আসা সব গরুই আটক হচ্ছে। ‘আগের তুলনায় সীমান্ত দিয়ে গরু অনেক বেশি আসছে অথবা চলতি বছর অনেক গরু দেশে প্রবেশ করছে’— এমন তথ্য সঠিক নয়।
 
খামারিদের তথ্য আর প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর হিসাব মেলালে এ শঙ্কা আরও প্রকট হয়। চলতি বছর চাহিদার চেয়ে প্রায় ১৫ লাখের অধিক পশু প্রস্তুত আছে। ফলে এবার তুলনামূলকভাবে পশুর দামও কম। এখন যদি সীমান্ত দিয়ে গরু আসে তাহলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিতে পড়বেন খামারিরা।

প্রায় এক যুগ ধরে গরু পালনের পাশাপাশি সারাদেশের খামারিদের বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়ে সহায়তা করছেন মুক্তি মাহমুদ। প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ এ খামারি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গরুর হাটে গেলে দেখা মিলছে ভারতীয় গরু। এসব গরু নিঃসন্দেহে সীমান্ত দিয়েই আসছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের খামারিরা সারা বছর পরিশ্রম করে তাদের স্বপ্নের ফসল এখন হাটে তুলছেন। এ সময় যদি সীমান্ত দিয়ে আসা গরু সেই স্বপ্ন ধ্বংস করে দেয়, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক। এ বিষয়ে সরকারের শুধু নির্দেশনা বা চিঠি দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সরাসরি মাঠপর্যায়ে নজরদারিসহ আনুষঙ্গিক সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তা না হলে উদীয়মান খামারিরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন।’


 
তবে এ বিষয়ে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রাণিসম্পদ-২) ড. অমিতাভ চক্রবর্তী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এক মাস আগে থেকেই এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি। জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি।’

তিনি বলেন, ‘মন্ত্রীমহোদয়সহ আমরা সবাই জেলা প্রশাসক ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। সবাই কিন্তু আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে, সীমান্তে কড়া পাহারা দেওয়া হচ্ছে। কোনো গরু আসছে না। আসলে, এ বিষয়ে আমাদের তো সরাসরি কাজের সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ত্রুটি রাখা হচ্ছে না।’
 
দুই যুগের বেশি সময় ধরে গরুর খামার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন আলতাব হোসেন। সিরাজগঞ্জের এ খামারি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের মধ্যে এখন শুধু একটাই ভয়, যদি সীমান্ত দিয়ে গরু আসে তাহলে আমাদের পথে বসতে হবে।

তিনি বলেন, প্রতি বছরই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। পাশাপাশি আগের চেয়ে চিকিৎসার ব্যয়ও বেড়েছে। সারা বছরের কষ্টের ফসল যদি ঈদের সময় বিক্রি করতে না পারি তাহলে মুখ থুবড়ে পড়বে সম্ভাবনাময় শিল্পটি।
 
খামারিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, অনেকেই সীমান্ত দিয়ে গরু আসছে বলে গুজব ছড়িয়ে দাম কমানোর চেষ্টা করছেন। খামারি জাহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, খুবই সচেতন হয়ে গরু বিক্রি করতে হবে। গুজবে কান দেওয়া যাবে না। আমিও শুনেছি যে, এবার প্রচুর গরু সীমান্ত দিয়ে আসছে। তাই দাম কম পড়বে। আসলে এটি সত্য নয়।

সীমান্ত পার হয়ে এবার কেমন গরু আসছে— এ প্রশ্নের উত্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের অপারেশন পরিদফতর শাখার পরিচালক লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সীমান্তে গরু চোরাচালান এবার বেশ নিয়ন্ত্রণে আছে। প্রতি বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যেভাবে আসার কথা এবার কিন্তু সেভাবে আসছে না। 
 
তিনি বলেন, সীমান্ত মানেই তো চোরাচালান। রুটিন অনুযায়ী এটা (গরু) আসছে এবং বিজিবি সেগুলো আটকও করছে। আমাদের তথ্য অনুযায়ী, যেগুলো (ভারতীয় গরু) আসছে তার সবই আটক হচ্ছে। গত ছয় মাসে অবৈধভাবে আসা ২৮৪৬টি গরু আটক করা হয়েছে। যার সিজার মূল্য ১৫ কোটি ৫৩ লাখ ৫১ হাজার ৩৬১ টাকা।
 
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের খামার শাখা জানায়, সারা দেশে চলতি বছর কোরবানিযোগ্য এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি পশু প্রস্তুত আছে। গত বছর প্রস্তুত ছিল এক কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি পশু। কোরবানি উপলক্ষে ওই বছর জবাই করা পশুর সংখ্যা ছিল ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি। এর আগের বছর এক কোটি চার থেকে পাঁচ হাজার পশু কোরবানি উপলক্ষে জবাই হয়।
 
একে/এমএআর/