সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার আগেই বাঁশি বাজিয়ে সতর্ক করছেন নীল ইউনিফর্ম পরিহিত বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্যরা। পানিতে নামা তো দূরের কথা, ঠিকমতো সৈকতও দেখতে দেন না তারা। করোনা সংক্রমণ রোধে গত ১ এপ্রিল থেকে সৈকতে পর্যটকসহ লোকজনের সমাগম নিষিদ্ধ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। এরপর থেকে গত সাড়ে তিন মাস প্রায় পর্যটকশূন্য কক্সবাজার।

ট্যুরিজমের শহর কক্সবাজারের সব ব্যবসাই পর্যটননির্ভর। পর্যটকরাই এখানকার ব্যবসাকে চাঙা রাখেন। কিন্তু করোনার বিধিনিষেধে পর্যটক আসা বন্ধ। বন্ধ আছে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের সবধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য।

কক্সবাজারের সুগন্ধা বিচ এলাকার সুবর্ণা স্টোরের মালিক জাহিদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই সময়ে দৈনিক ১২-১৩ হাজার টাকা বিক্রি হলেও এখন মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বিক্রি করতে পারি। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো ঈদুল ফিতর থেকে ঈদুল আজহার পরবর্তী ১০-১৫ দিন। গত বছর ঈদুল আজহার পরে বিক্রি কিছু বেড়েছিল। তবে এবার তেমন কোনো বেচাকেনা নেই। দুজন স্টাফ নিয়ে দোকান টিকিয়ে রাখা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

অধিকাংশ হোটেলে তালা, খোলাগুলো ফাঁকা

সরেজমিনে সুগন্ধা বিচ এলাকার দ্যা কক্সবিচ রিসোর্টে গিয়ে দেখা গেল, হোটেলের ৬৫ রুমের মধ্যে মাত্র সাতটি রুমে পর্যটক রয়েছেন। বাকিগুলো ফাঁকা।

এ হোটেলের ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার ফোরকান জানান, ‘ঈদের পর ১৫-২০ দিন শত ভাগ রুম ভাড়া থাকত। আর জুন-জুলাই মাসে হোটেলের কমপক্ষে ৫০-৬০ ভাগ রুম ভাড়া থাকত। এখন ৫-৭ ভাগ রুমে লোকজন আছেন।’

এই হোটেলের পাশেই ইকরা বিচ হোটেল। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাইরে তালা ঝুলছে। ফোন দিলে কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘এখন হোটেল খুললে লোকসান আরও বাড়বে। তাই পর্যটক না আসা পর্যন্ত হোটেল বন্ধ থাকবে।’ 

কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সম্পাদক মুকিম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখানে ৫২টি হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। আমরা করোনা সংক্রমণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। তারপরও কর্মচারীদের মানবিক দিক বিবেচনায় নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘হোটেল-মোটেল বন্ধ থাকায় অন্তত পাঁচ হাজার কর্মচারী বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ কর্মচারীর বেতন-ভাতাও পরিশোধ হয়নি। এরমধ্যে নতুন বিধিনিষেধ সংকট বাড়াবে। একেবারে খারাপ অবস্থা। সবকিছু বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা।’

বিলাসবহুল তারকা হোটেলগুলোর মধ্যে সুগন্ধা বিচ এলাকার সি-প্রিন্সেস হোটেলটিও বন্ধ পাওয়া গেল। পাশেই অবস্থিত লং বিচ হোটেলটি আংশিক খোলা। হোটেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার বললেন, ‘যারা অতিজরুরি প্রয়োজনে কক্সবাজার এসেছেন এবং হোটেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রেফারেন্সে এসেছেন কেবল তাদেরকেই রুম দেওয়া হচ্ছে।’

কক্সবাজারের রয়েল টিউলিপ সি-পার্ল হোটেলের একজন কর্মচারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হোটেল খোলা রয়েছে। তবে ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে কেবল ২০-২৫টি রুম। কক্সবাজারে কর্মরত দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং এনজিওকর্মীদের আইডি কার্ড দেখে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।’

ট্যুরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কক্সবাজারে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অর্ধকোটি পর্যটক আসেন। তাদের যাতায়াতে প্রতিদিন দূরপাল্লার অনেক বাস ও ১০-১২টি ফ্লাইট যাতায়াত করে। পর্যটক সেবায় থাকা হোটেল-মোটেল, কটেজ ও রেস্টুরেন্ট এবং বিমান চলাচলসহ কোনো খাতই গেল দেড় বছরে সুবিধা করতে পারেনি। এতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা ভেস্তে গেছে।’

টমটম চালকদের অলস সময়

কক্সবাজারের টমটমের (ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা) চালকরাও বর্তমান পরিস্থিতিতে বিরক্ত। তাদের বেশ কয়েকজনকে বিষণ্ণ মনে গাড়ি নিয়ে লাবণী বিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখা যায়। যারা চলাচল করছেন তারাও আগের চেয়ে অনেক কম ভাড়ায় যাচ্ছেন।

টমটম চালকরা বলছেন, আগে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে সুগন্ধা, লাবণী ও কলাতলী বিচের ভাড়া ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। বর্তমানে তারা ৮০ থেকে ১০০ টাকায় যাচ্ছেন। এছাড়াও বিমানবন্দর থেকে হিমছড়ি, ইনানী বিচ এলাকায় ভাড়া ছিল ৫০০ টাকা। বর্তমানে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যাচ্ছে।

কক্সবাজারের টমটম চালক মো. রনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটি টমটমে সাধারণত ছয় জন যাত্রী বসতে পারেন। বর্তমানে এক ট্রিপে ৩-৪ জনের বেশি যাত্রী পাওয়া যায় না। আর আগে টমটম রিজার্ভ নিলে সর্বনিম্ন ৩০-৪০ টাকা ভাড়া ছিল। বর্তমানে আমরা ২০ টাকায়ও যাচ্ছি। অথচ আমাদেরকে দৈনিক ৭০০ টাকা করে জমা দিতে হচ্ছে।’

লাইভ ফিস খাওয়ার লোক নেই

দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতগুলোর পাশেই দোকান দিয়ে জীবন্ত মাছের বার-বি-কিউ বা ফ্রাই করে দেওয়া হতো পর্যটকদের। বর্তমানে এসব ব্যবসায় মন্দা চলছে। সন্ধ্যার পর কক্সবাজারের প্রধান তিনটি বিচের মধ্যে কলাতলী ও সুগন্ধা পয়েন্টে গিয়ে একটি দোকানও খুঁজে পাওয়া যায়নি। লাবণী পয়েন্টে গিয়ে দুটি ভ্যানে মাছ বিক্রি করতে দেখা যায়। আগে বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়াসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ বিক্রি হতো। বর্তমানে চিংড়ি, কাঁকড়া, স্কুইড, কোরাল, রূপচাঁদা, স্যামন ও টুনা ছাড়া অন্য কোনো মাছ মেলে না।

মো. আব্দুল মমিন নামে এক বিক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। আগে যখন বিচ জমজমাট ছিল তখন আমরা দিনে চার-পাঁচ হাজার টাকার ব্যবসা করতাম। আকারভেদে ১০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চিংড়ি বিক্রি করতাম। কাঁকড়া ৩০ থেকে ১০০ টাকা। এখন দাম অর্ধেক করেছি। তাও দিনে হাজার টাকা বিক্রি করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে বাড়ি চলে গেছেন।’

দরকষাকষি নেই বার্মিজ মার্কেটে

কক্সবাজারের বাজার ঘাটা এলাকায় একসঙ্গে প্রায় ১০-১২টি বার্মিজ মার্কেট রয়েছে। এগুলোতে বিক্রি হয় মিয়ানমারের আচার, সাবান, শাল, লুঙ্গি, স্যান্ডেল, ব্যাগসহ নানা সামগ্রী। ২৪ জুন সরেজমিনে এই এলাকায় গিয়ে দেখা গেল মার্কেটে কোনো ক্রেতা নেই। এলাকার কে অ্যান্ড কে বার্মিজ মার্কেটের একটি দোকান ঘুরে গুটিকয়েক ক্রেতাকে মার্কেটে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল।

দোকানিরা ‘একদাম’ বলে তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করছেন। মার্কেটে ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্লাস্টিকের বার্মিজ স্যান্ডেলগুলো। যেগুলো আগে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা ছিল। এছাড়াও বার্মিজ শাল ৩২০ টাকা, লুঙ্গি ২৫০ টাকা, বড় টাওয়েল ২২০ টাকা, ১২ পিসের হারমনি সাবান (৭০ গ্রাম) ২২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। 

বিক্রেতাদের দাবি, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বর্তমানে প্রায় অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।

মায়ের দোয়া বার্মিজ স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. সাকিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ (মঙ্গলবার-২৩ জুন) বিকেল পৌনে ৪টার দিকে প্রথম বিক্রি করলাম ২২০ টাকা। এভাবে প্রতিদিন বিক্রি শুরু হতে হতে দুপুর হয়ে যায়। কক্সবাজারে কোনো পর্যটক নেই। রোহিঙ্গা নিয়ে যারা কাজ করছেন শুধু তারাই এখন কক্সবাজারে আছেন। তাই আমাদের ক্রেতা অনেক কম। যারাই কেনাকাটা করতে আসে তাদের সঙ্গে তেমন দরকষাকষি করছি না। ১০-২০ টাকার ফারাকে পণ্য বিক্রি করছি। 

যে খুলছে তারই লোকসান বাড়ছে

কক্সবাজারের সুগন্ধা বিচ এলাকার ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্ট বিচ বিরাম। ম্যানেজার, স্টাফ-বাবুর্চিসহ রেস্টুরেন্টটি মোট ১৪ জন নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। 

রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গেল, গত পাঁচ দিনে (১৯ জুন থেকে ২৩ জুন) গড়ে রেস্টুরেন্টে খেয়েছে মাত্র ৬৩ পরিবার। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২টি পরিবার এখানে খেয়েছেন। তিন বেলার হিসেব করলে প্রতিবেলায় মাত্র চারজন।

রেস্টুরেন্টের স্টাফ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘দুই হাজার স্কয়ার ফিটের রেস্টুরেন্ট ভাড়া, বিলসহ অনেক খরচ। অথচ আমাদের প্রতিদিনের স্টাফ খরচও উঠছে না। বিচ বন্ধের কারণে কক্সবাজারে এখন পর্যটক নেই, প্রতিদিন লোকসান বাড়ছে।’

২৩ জুন সুগন্ধা এলাকার ঝাউতলা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা গেল রেস্টুরেন্টটির মেন্যুতে দুপুর ও রাতের জন্য মোট ১৬৪ পদের খাবার থাকলেও বর্তমানে শুধুমাত্র গরুর মাংস, মুরগির মাংস, কোরাল মাছ, লইট্যা ফ্রাই এবং আইল মাছ রান্না করেছে। সঙ্গে দুই পদের সবজি আর তিন-চার ধরনের ভর্তা। চাহিদা না থাকায় রান্নাবান্নাও সীমিত করে ফেলেছে রেস্টুরেন্টগুলো।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গেল প্রায় দেড় বছরে কক্সবাজারে সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পর্যটন অর্থনীতি নিম্নমুখী। আমাদের হিসাবে প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে আর কিছুদিন চললে আরও ধস নামবে। ইতোমধ্যে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে নতুন করে লকডাউন এ ব্যবসায় চরম সংকট সৃষ্টি করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের ভ্যাট ও কর মওকুফের আবেদনও করা হবে। এছাড়া ব্যাংক ঋণের চাপ কমানোর ব্যবস্থাও করা হবে।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার ঘোষিত লকডাউন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন কঠোরভাবে কাজ করছে। সেই সঙ্গে হোটেল-মোটেল জোনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকায়দায় পড়ছেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদেরকে বিশেষ প্রণোদনার আওতায় আনা হবে।’ 

মুহিবুল্লাহ মুহিব/এআর/জেইউ/ওএফ