কোভিড ট্রায়েজ রুমের সামনে স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন শেখ মো. সিরাজ। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন তিনি। স্ট্রেচারে শুয়ে ছটফট করতে থাকা সিরাজের শরীর কাঁপছিল, ঘামছিলও। প্রায় ২০ মিনিট ধরে তাকে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তার সঙ্গে আসা দুই স্বজন গেছেন ভবনের উপরে করোনা ইউনিটে, সিট পাওয়ার আশায়। শুক্রবার (৯ জুলাই) বেলা ১২টা ১০ মিনিটে হাসপাতালে এ দৃশ্য দেখা যায়।

কোভিড ট্রায়েজ রুমের সামনে স্ট্রেচারে শুয়েই অসুস্থ শেখ মো. সিরাজ এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘প্লিজ আমাকে বাঁচান, তাড়াতাড়ি ভর্তি করার ব্যবস্থা করুন। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, শ্বাস নিতে পারছি না, শরীরে কাঁপুনি দিচ্ছে। আমাকে অন্তত কোনো ফ্যানের নিচে নিয়ে বসান। এই হাসপাতালের ডিডি (ডেপুটি ডিরেক্টর) নিউরো সার্জন ফারুক আমার বন্ধু। কেউ ফোন করে জানান, আমি অসুস্থ। ও অবশ্যই আসবে।’

শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে শেখ মো. সিরাজকে হাসপাতালে নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্সের চালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখানে করোনার ক্রিটিক্যাল রোগী ছাড়া ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। শুনলাম আইসিইউ বেডও খালি নেই। রোগীর সঙ্গে দুজন আত্মীয় এসেছেন। তারা খোঁজ-খবর নিতে উপরে গেছেন। কিন্তু ২০ মিনিট পার হলেও তারা নিচে নামছেন না। এদিকে রোগীর অবস্থা খারাপ।’

শুধু শেখ সিরাজই নন, এমন অসংখ্য রোগী প্রতিদিন শ্বাস কষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। তাদের সবাইকে চিকিৎসা দিতে পারছেন না সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ বেশি। দুই শতাধিক করোনা রোগী এইমুহূর্তে ভর্তি আছেন। তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত নন। সবারই কম-বেশি অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে। অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে না বা শ্বাস-কষ্ট নেই এমন করোনা রোগীকে হাসপাতালটিতে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।

হাসপাতালের দোতলায় অবস্থিত করোনার জন্য বিশেষায়িত ইউনিট। সেখানে গ্রিন জোন ও রেড জোন ভাগ করা আছে। রেড জোনের সামনে বেঞ্চে বসে আছেন নোয়াখালী থেকে আসা আব্দুল মতিন। তিনি জানান, ৪-৫ দিন আগে স্ত্রীর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। নিশ্বাস যেন আটকে আছে, এরকম অবস্থা। অবস্থা বেগতিক দেখে স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে নিয়ে যান নোয়াখালীর চাটখিলে। সেখানে হাসপাতালে করোনা টেস্ট করান। পজিটিভ রিপোর্ট আসার আগেই স্ত্রীর অবস্থার অবনতি হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

তিনি বলেন, রাজধানীর দুই হাসপাতাল ঘুরেছি কিন্তু সিট পাইনি। অবশেষে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাই।

বৃদ্ধ আব্দুল মতিন বলেন, চলমান ‘লকডাউনের’ মধ্যে স্ত্রীকে বাঁচাতে ঢাকায় আসতে হয়েছে প্রাইভেটকার ভাড়া করে। রাস্তায় পুলিশ কাগজপত্র দেখে ছেড়ে দিয়েছে। আসার সময় ছেলে-মেয়ে কাউকেই পাশে পাইনি। এক জামাতা এলেও ভর্তি করে দিয়ে চলে গেছে।

ডায়াবেটিসে ভোগা রোগী রোকেয়ার বমি আর শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। যে কারণে স্ত্রীকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় স্বামী আব্দুল মতিন। মেয়েরা বিবাহিত, ছেলে থাকে বিদেশে, এখন স্ত্রীর দেখভাল তাকেই করতে হচ্ছে।

হাসপাতালটির মূল ফটকে কোভিড ট্রায়েজ রুমের সামনে স্ট্রেচারে শোয়া মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা থেকে আসা করোনা রোগী মোনেস মোল্লা। অক্সিজেন সাপোর্টেও শ্বাস-কষ্ট হচ্ছে তার। ওই রোগীর সঙ্গে থাকা ভাতিজা বাদল মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন দিন ধরে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে চাচার। এনাম মেডিকেলে করোনা টেস্ট করতে দিয়েছি। রিপোর্ট পাইনি। কিন্তু অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সাপোর্টে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে এসেছি এই হাসপাতালে। জানি না এখানে ভর্তি করাতে পারব কি না, চেষ্টা করে যাচ্ছি।

গতকালই (বৃহস্পতিবার) শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে বড় ভাইকে ভর্তি করেছিলেন সাভার থেকে আসা দেলওয়ার হোসেন। করোনার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই আজ সকালে মারা যান ভাই রমজান। ছোট ভাই দেলওয়ার বলেন, কী করব, চিকিৎসা করানোর তো সময় পেলাম না। করোনার রিপোর্টে কী এল তা আর জেনেই বা কী করব। ভাই তো মারাই গেল। জীবিত ভাইকে নিয়ে এসেছিলাম, ফিরছি লাশ নিয়ে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নতুন পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। যদিও স্বস্তির কথা হলো, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ইউনিটে কেউ মারা যাননি। আমাদের এখানে ভর্তি দুই শতাধিক করোনা রোগী। যাদের কাউকেই আমরা শঙ্কামুক্ত বা কম শঙ্কামুক্ত বলছি না। সবারই কম-বেশি অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে শ্বাসকষ্ট যাদের নেই, এমন করোনা আক্রান্ত রোগীকে ভর্তি নিতে পারছি না। তাদের পরামর্শপত্র দিয়ে বাসা থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করছি। আমাদের এখানে করোনা রোগীর জন্য বরাদ্দ করা ১০ আইসিইউ বেডই এখন পূর্ণ। নতুন করে কাউকে সেখানে স্থানান্তর করাও সম্ভব হচ্ছে না।

জেইউ/এসএসএইচ/জেএস