শ্রমজীবী মকবুল

কাকডাকা ভোরে যখন কঠোর বিধিনিষেধের কার্যকারিতা শুরু হয়েছিল, তখন চিরচেনা দৃশ্যপট ছিল না রাজধানী ঢাকার পথে পথে। ছিল না কাজে বের হওয়া মানুষের সরব উপস্থিতি। ছিল না সড়কে যানবাহনের ভিড়। খুব প্রয়োজন কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছিলেন না। 

কিন্তু রাজধানীর নতুন বাজার থেকে কুড়িলের দিকে যাওয়ার পথে বাঁ দিকের যাত্রী ছাউনিগুলো আর ফুটপাতে সকাল থেকেই দেখা যাচ্ছিল মানুষের উপস্থিতি। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি ছিল নারীর উপস্থিতিও। 

সবার হাতেই কোদাল, খুন্তি, ডালি বা শাবল। বুঝতে বাকি রইলো না তারা শ্রমজীবী মানুষ। এখানে এসেছেন নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে। বলতে গেল শ্রম বিক্রির হাট এটি। প্রতিদিন ভোরে তারা এখানে এসে বসে থাকেন, অপেক্ষা করতে থাকেন কখন তাদের শ্রম কেউ কিনতে আসবে। এরপর ক্রেতা আসেন, দরদাম হয়, বনিবনা হলে চলে যান কাজে। 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারের দেওয়া কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিনে আজও তারা একইভাবে বসে ছিলেন একই স্থানে। ভোর থেকে সকাল হলো, বেলা বাড়তে থাকল, সড়কে মানুষের আনাগোনাও বাড়ল। কিন্তু তারা বসেই থাকলেন। বিধিনিষেধে স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ থাকায় কেউ তাদের শ্রম কিনতে আসেননি।  

দিন এনে দিন খাওয়া এসব মানুষের কপালে ছিল চিন্তার ভাঁজ। আজ যদি শ্রম বিক্রি না হয়, তবে পরিবার নিয়ে খাবে কী? লকডাউনের (বিধিনিষেধ) বাজারে নিজের শ্রম বিক্রি করতে না পেরে তাদের সবারই চোখে মুখে হতাশা আর অসহায়ত্বের ছাপ। তবুও তারা অপেক্ষা করে যাচ্ছেন, যদি কেউ আসেন, শ্রম যদি বিক্রি করা যায়, তাহলে সন্ধ্যায় বাজার করে পরিবার নিয়ে রাতের খাবারটা খাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের শ্রম তো কেউ কিনতে আসছেন না।

নতুন বাজার থেকে কুড়িলের দিকে একটু সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখা হলো ষাট বছর বয়সী মকবুলের সঙ্গে। জানালেন, তিনি কাজের অপেক্ষায় আছেন। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সকাল থেকে বসে আছি। এখন দুপুর হয়ে যাচ্ছে। কেউ আমাদের কাজে নিতে আসেননি। দিনের ইনকাম দিয়ে সন্ধ্যায় বাজার করে বাড়ি ফিরি। কাজ না থাকলে খাওয়া নেই। আজ লকডাউন, তাই এখন পর্যন্ত কোন কাজ আসেনি। কাজ না করলে খাব কী? বাড়িতে ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রী বসে আছে। বাজার নিয়ে গেলে রান্না হবে। কিন্তু কাজ তো পেলাম না। এখনও বসে আছি। যদি কেউ আসেন।

আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখা হলো চয়ন মিয়া নামের একজনের সঙ্গে। মধ্যবয়সী এ মানুষটি কোদাল আর ডালি নিয়ে বসে আছেন তিনি। তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোরে এখানে প্রায় ১০০-১৫০ শ্রমিক কাজের জন্য বসে থাকেন। ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় দিন চুক্তিতে তারা কাজ করেন। আজ লকডাউন। তাই আমাদের কাজে নিতে কেউ আসেননি। আজ যদি কাজ নাই পাই, তাহলে বাড়ি ফিরে যেতে হবে খালি হাতে। না খেয়ে থাকতে হবে আজ। লকডাউন দিক, কিন্তু আমাদের কোনো ব্যবস্থা না করলে তো পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

তিন মাস ঘর ভাড়া দিতে পারেননি জানিয়ে চয়ন মিয়া বলেন, ভাড়া না দেওয়ায় বাড়ির মালিক মারধরও করেছে। কিন্তু কী করব, সব সহ্য করে যেতে হচ্ছে। ইনকাম নেই, তাই ঘর ভাড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রতিদিনই খাওয়ার কষ্ট আমাদের আছেই। লকডাউনে আরও বেশি এই কষ্ট পেতে হয়। কাজ না করলে তো কেউ খাওয়ার দেবে না। তাই লকডাউনের দিনেও পেটের দায়ে রাস্তায় এসে বসে আছি, যদি কেউ কাজের জন্য নিয়ে যান, তাহলে অন্তত খেতে পারব।

মনির হোসেন নামে আরেক শ্রমজীবী বলেন, লকডাউন দেয়, কিন্তু আমাদের কথা তো কেউ ভাবেন না।  লকডাউনে আমরা খাবো কী? লকডাউন মানে আমাদের মতো মানুষদের না খেয়ে থাকা। লকডাউন দিলে কেউ কাজে নেন না। একদিন না কাজ করলে ওই একদিনই আমাদের ছেলে মেয়ে স্ত্রী নিয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। গ্রামের বাড়ি যে চলে যাব, তারও উপায় নেই, কারণ গ্রামে এখন কাজ নেই। তাই লকডাউন দিলেই আমাদের কপাল পুড়ে।

এএসএস/আরএইচ