চারপাশে সবুজ আর সারি সারি টিলা। টিলাগুলোর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা পথ। উঁচু-নিচু এই সব টিলার মাঝ দিয়ে হেঁটে এখানে পৌঁছাতে হতো কিছুদিন আগেও। রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানি এমন কী শিক্ষার আলো পর্যন্ত ছিল না।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদ থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত আশিদ্রোন ইউনিয়ন। এখানে বসবাস করা ৫০টি পরিবার লিজ নেওয়া ১৮০ একর জমির ওপর পান চাষ করে। ২-৩ একর থেকে ১০-১৫ একর পর্যন্ত জমিতে একেকটি পরিবার চাষ করেন পান।

‘এখানে এসেছি বাপ দাদা থাকতে। পান চাষ করবো। এইটা দিয়া বাচ্চা-কাচ্চারে মানুষ করাইবো। ত্রিশ বছর হইছে এইখানে আমরা থাকি। এই জায়গায় আমরা যখন আইছি প্রথম তখন খুব কষ্ট ছিল জীবনে’- এইভাবেই এখানকার জীবন-যাপনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা বেইলি সুরং। 

স্বামী, ছেলে আর মেয়ে নিয়ে ৪ সদস্যের পরিবার তার। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের আমলে তো নাম দস্তগত করতে পারি না। এইখানে জন্ম করে, এইখানে সবকিছু আত্মীয়-স্বজন। সম্পদ থোরা আছিল। সম্পদটা বেচিয়া পুড়িরে পড়াইয়া অখন আমরা কষ্ট করিয়া দুই পয়সা রুজি করিয়া খাই।’

এ জনপদের যোগাযোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে বেইলি সুরং বলেন, ছুট্টু। এখন আমরা খুশি হইলাম প্রধানমন্ত্রী আমরারে রাস্তা, ব্রিজ- সব কিছু দিলো। পান কুচি করে বেশি ইনকাম নাই। ইনকাম কম। এর জন্য বাচ্চা-কাচ্চা লেখাপড়া করাতে পারি না। আমাদের রুজি কম, কষ্ট বেশি। এই যে আমার মেয়েরে কষ্ট করে লেখাপড়া করাইলাম। এইখানে স্কুল তারে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সাহায্য দেবেন।’ 

বেইলি সুরংয়ের মেয়ে আনীতা সুরং। ভারতের মেঘালয় থেকে খাসিয়া ভাষায় পড়ালেখা করেছেন। স্থানীয় এক খাসিয়া ছেলেকে বিয়ে করে এখানেই সংসার পেতেছেন। তার কর্মসংস্থান হয়েছে হোসনাবাদ খাসিয়াপুঞ্জি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।  

৩০-৩৫ জন খাসিয়া শিক্ষার্থীর এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকালে বাংলা ও বিকেলে খাসিয়া ভাষায় ক্লাস হয়। খাসিয়া শিশুদের হাতে মায়ের ভাষার বই। মায়ের ভাষায় শিশুদের পাঠদান করেন এই আনীতা সুরং। 

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে বাংলায় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা এমাডি পরম্যান বলেন, ‘আমাদের কৃষ্টি-কালচার ও ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় অন্তত একটি করে সরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলে এ ভাষায় লেখা-পড়া করা যাবে। আমাদের ভাষা সংরক্ষণ করা যাবে।’

‘ইন্ডিয়া থেকে আমরা লেখাপড়া করে আমাদের ভাষা সংরক্ষণ করি। এ জিনিসটা আমাদের বাসায় পৌঁছাই দিল, আমাদের হাতে পৌঁছাই দিল- এই জিনিসটা মানুষের রক্ত দিয়ে আনতে হয়। কিন্তু আমাদের এই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের হাতে পৌঁছাই দিছে বিনামূল্যে, বিনা অর্থে, বিনা পরিশ্রমে’- বলছিলেন খাসিয়া পুঞ্জ প্রধান ওয়েল সুরং। 

স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে মন্ত্রী বলেই জানেন। বংশ পরমপরায় নির্বাচিত হওয়ায় পুঞ্জ প্রধানরাই খাসিয়াদের ভালো-মন্দ দেখভাল করেন স্থানীয়ভাবে। 

খাসিয়া ভাষায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বই পাওয়ায় ওয়েল সুরং বলেন, ‘তার চেয়ে বড় আর কি? আমি ধন্যবাদ দেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে। আমাদের এই যে বই পৌঁছাই দিছে তা আরো উন্নতি করুক। তার পারপাসে আমাদের যে মাস্টারনি রাখছি তার যদি সহযোগিতা করে আমাদের জইন্যে আর একটু আগোয়ায় হয়।’ 

‘খাসিয়া সম্প্রদায়ের পানের ওপর জীবন। তারা পান চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করে। একটা পরিবারের সব সদস্য একটা পান গাছের ওপর নির্ভর থাকে। রাস্তা ছিল না। তারা হেঁটে যেত’- জানান শ্রীমঙ্গল উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাভেদ। 

শিক্ষিত হয়েও পারিবারিক ব্যবসা পান চাষ করছেন এমাডি পরম্যান। তিনি জানান, বছরে তিন-সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় হয় দুই একর জমির ওপর পান চাষ করে। দেড় লাখ টাকা ব্যয় হয় পান চাষে। তিন ভাই, এক বোন ও মাকে নিয়ে সংসার চলে যায় এই আয় দিয়ে।

খাসিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ওয়েল সুরং বলেন, এখন আর কষ্ট করে পান খাঁচি মাথায় তুলে হেঁটে শ্রীমঙ্গল যেতে হয় না। আড়তদাররা আশিদ্রোন এসে পান কিনে নিয়ে যায়। উচিত মূল্যও পান চাষিরা। রাস্তা ঘাট ছিল না। রোগীদের আমরা ভাড় করে নিয়ে যেতাম শ্রীমঙ্গল শহরে। আমাদের এখানে একমাত্র যোগাযোগ শ্রীমঙ্গলেই।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাভেদ বলেন, হোসনাবাদ খাসিয়াপুঞ্জিতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থায়নে সিঁড়ি, দুটি ব্রিজ এবং শিক্ষাবৃত্তি বাই সাইকেল, সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে। 

তিনি বলেন, তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন এ রাস্তা করে দিয়েছে। রাস্তাটি ইটের সোলিং বা আরসিসি ঢালাই করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী অর্থায়নে ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। 

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা যাওয়ায় অষ্টম শ্রেণি পাস করে লেখাপড়ার পাঠ চুকান মেলডি সুরং। সংসারের ব্যয় মেটাতে পারিবারিক ব্যবসা পান চাষে নেমে পড়েন।

অর্ণিকা সুরং লেখাপড়া করেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। সরকারি অনুদানে একটি সেলাই মেশিন পেয়েছেন। সেলাই করে সংসার পরিচালনায় সহযোগিতা করেন।

খাসিয়া পুঞ্জ প্রধান ওয়েল সুরং বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের অনুদান হিসেবে শেলাই মেশিন, বাইসাইকেল ও শিক্ষা অনুদানসহ বিভিন্ন প্রকারের সুবিধা পেয়ে আসছেন। ফলে তাদের জীবন বদলাতে শুরু করে।

তিনি বলেন, এখানে পাঁচ বছর আগে এলো বিদ্যুৎ। তিন বছর আগে আমাদের ব্রিজ দুটা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দিলো সিঁড়ি। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা দিয়েছে। স্কুল দিয়েছে আমাদের। ঘর-বাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আবেদন করা আছে।  

ওয়েল সুরং বলেন, আগে বিদ্যুতের অভাবে সেচ বাধাগ্রস্ত হতো। বছরে বৃষ্টির দিনেই কেবল পান চাষে কিছু মুনাফা আশা করতেন কৃষকরা। বছরে ৬ মাস পান চাষ করতো। এখন বিদ্যুৎ সংযোগে সেচের সুবিধা থাকায় সারাবছরই পান চাষ করতে পারেন খাসিয়ারা। এই সরকারের আমাদের প্রতি একটা সুনজর। সরকার যদি আরও পাঁচটা বছর থাকে আমাদের জীবন পাল্টে যাবে। 

উপজেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাভেদ জানান, ১২টি খাসিয়াপল্লি, খাসিয়া গারো মিলিয়ে আরও ১৫টি পল্লি, ৪২টি চা বাগান, ৩০ হাজারের অধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস শ্রীমঙ্গল উপজেলার। 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন জানান, সমতলে বসবাস রত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে ১৫ হাজার জনকে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা শিক্ষা বৃত্তি দেওয়া হয়েছে উপজেলা পর্যায়ে। ২ কোটি ৪০ হাজার টাকার ২ হাজার ৬৭২টি বাইসাইকেল, ১ কোটি ৫২ লাখ টাকার শিক্ষা উপকরণ পেয়েছে ৮ হাজার ৬৫০ জন। 

প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস জানান, ৮ বিভাগের ৪৬ জেলার ২০৭টি উপজেলার সমতলে বসবাসরত ৫০ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে বাস্তবায়নাধীন বিশেষ এলাকার (পার্বত্য এলাকা ব্যতীত) জন্য উন্নয়ন-সহায়তা শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বমোট ৭৩ কোটি ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

এইউএ/এসএম