বজ্রপাতে প্রতিবছর শত শত মানুষ মারা গেলেও অনাকাঙ্ক্ষিত এ মৃত্যু ঠেকাতে নেই কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর কয়েক লাখ তালগাছ রোপণ ও কিছু তথ্য প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সব কার্যক্রম। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন, তথ্য তুলে ধরা ও সচেতনতার কাজটি করতে পারলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তারা বলছেন, সঠিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পূর্বাভাস তুলে ধরতে পারলে বজ্রপাতে মৃত্যুহার অনেক কমে যাবে।

আবহাওয়াবিদ ও বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ড. আবুল কালাম মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বজ্রপাতের সঠিক তথ্য সরবরাহ করাটা আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বজ্রপাত প্রবণ এলাকায় বার্তাটি যদি সঠিক সময়ে দ্রুত পৌঁছাতে পারি, তাহলে অনেকেই প্রাণে বেঁচে যাবেন।

মানুষকে সচেতন হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সাধারণ মানুষেরাও যে খুব বেশি সচেতন, তা কিন্তু নয়। এ বিষয়ে আমাদের একটি হটলাইন রয়েছে। ১০৯০ নম্বরে কল করে মানুষ এ বিষয়ে তথ্য জানতে পারেন। কিন্তু সেভাবে মানুষের সাড়া পাওয়া যায় না। আমরা প্রতিদিনের তথ্য নোটিশ আকারে প্রকাশ করি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। পরে বজ্রপাত থেকে নিরাপদে থাকতে সতর্কতামূলক বার্তা প্রচার শুরু করে মন্ত্রণালয়। এর বাইরে প্রায় ৬০ লাখ তালগাছ লাগানো হয়। কিছু জেলায় বজ্রনিরোধক স্থাপন করা হলেও এখনও সেগুলো চালু করা হয়নি।

অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। বিশেষ করে হাওর এলাকার খোলা স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করা হবে। বজ্রনিরোধক স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলছে।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রশিক্ষণ) (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নিতাই চন্দ্র দে সরকার বলেন, বজ্রপাতে কেউ মারা গেলে দাফন, কাফনসহ আনুষঙ্গিক প্রায় সব সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য দুর্যোগে মারা গেলে সরকারিভাবে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে, বজ্রপাতে মারা গেলেও সেই নিয়ম অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আট জেলায় আবহাওয়া অফিসের মাধ্যমে বজ্রনিরোধক স্থাপন করা হয়েছে। যদিও এখনও চালু করা হয়নি। এছাড়া বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় আমরা নানা ধরনের কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এসবের ফলে বজ্রপাতে মৃত্যুহারও আগের তুলনায় অনেকটা কমে এসেছে বলে দাবি করে এ কর্মকর্তা।

বজ্রপাতে গেল চার মাসে ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি বেসরকারি সংগঠন। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে কী করা উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক জানান, বজ্রপাতে শুধু মানুষ মারা যায় এমন নয়, পশু-পাখিও হতাহত হয়। হিসাব করলে দেখা যায়, এখন ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে বেশি মানুষ এই বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন। আবহাওয়া অধিদফতরের জারি করা সতর্কতা মেনে চলতে হবে, আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুসরণ করতে হবে। বজ্রমেঘ দেখে চিনতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন মোবাইল টাওয়ারে বজ্রনিরোধক বসানো যেতে পারে।

বজ্রঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে না জানিয়ে এ আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ বলেন, মারা যাওয়ার খবর বেশি আসছে। খোলা মাঠে কাজ করার প্রবণতাও বাড়ছে। এসব কারণে আমাদের সচেতনতা বাড়ানোর দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

পরামর্শ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, বজ্রপাতের সময় ঘর হলো সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। কাছাকাছি যদি কোনো ঘর না থাকে, সেক্ষেত্রে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকতে হবে। বিদ্যুতের খুঁটির নিচে দাঁড়ানো যাবে না। বড় গাছের নিচেও দাঁড়ানো ঠিক হবে না। বজ্রঝড় আশ্রয়কেন্দ্র থাকলে সেখানে আশ্রয় নিতে হবে।

আবহাওয়া অফিস জানায়, বজ্রঝড় কয়েক রকমের হয়ে থাকে। মেঘ থেকে মেঘের সঞ্চালনের ফলে বজ্রঝড় তৈরি হতে পারে। মেঘ থেকে মহাকাশে শূন্যেও বজ্রঝড় তৈরি হতে পারে। মেঘ থেকে তৈরি হয়ে পৃথিবীতে নাও আসতে পারে বজ্রঝড়টি। আরেকটা হতে পারে, মেঘ থেকে ভূপৃষ্ঠে আসতে পারে বজ্রঝড়টি। বিনা মেঘেও বজ্রপাত হয়ে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা রয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ডিপার্টমেন্ট অব ইলেক্ট্রিক্যাল ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বজ্রপাতে কমবেশি মানুষ মারা যান। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার পরও কিন্তু মানুষ মারা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে অবশ্যই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যত দ্রুত আমরা সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারব, তত দ্রুত মৃত্যুহার কমে আসবে। তবে অবশ্যই পদক্ষেপটি বিজ্ঞানসম্মত হতে হবে।

১১ জুন সেভ দ্যা সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০২১ সালের মার্চ থেকে জুন মাস (১০ জুন) পর্যন্ত চার মাসে বজ্রপাতে অন্তত ১৭৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। এর মধ্যে শুধু কৃষি কাজ করতে গিয়েই মৃত্যু হয়েছে ১২২ জনের।

এসময় ফোরামের পক্ষ থেকে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই আবহাওয়া অধিদফতর জানতে পারে কোন কোন এলাকায় বজ্রপাত হবে। এ তথ্য মোবাইলে মেসেজ আকারে পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে জানানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুহার যত, তার চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যুহার বজ্রপাতে। তবে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করলেও এ খাতে বরাদ্দ কম। মানুষের জীবন রক্ষার্থে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

মাঠে, হাওর বা ফাঁকা কৃষি কাজের এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, যার ওপর বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হবে যেন বজ্রপাতের সময় কৃষক সেখানে অবস্থান বা আশ্রয় নিতে পারেন।

বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে থান্ডার প্রটেকশন সিস্টেমের সব পণ্যে শুল্ক মওকুফ করতে হবে। সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বাড়িতে বাড়িতে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের ঘোষণা দিতে হবে। পাশাপাশি বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা- থান্ডার প্রটেকশন সিস্টেম যুক্ত না থাকলে নতুন কোনো ভবনের নকশা অনুমোদন না করার দাবি জানায় সংগঠনটি।

একে/এসএসএইচ