বিনাদোষে কেন জেল খাটতে হলো, দোষীদের বিচার চায় মিনু
যাদের কারণে প্রায় ৩ বছর জেলে থাকতে হয়েছে সেই ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন নিরপরাধ মিনু আক্তার। বুধবার (১৬ জুন) কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জেল গেটের সামনে সাংবাদিকদের একথা বলেন।
চট্টগ্রামে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার কুলসুমার হয়ে জেল খাটা নিরপরাধ মিনু প্রায় ৩ বছর পর বুধবার চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
বিকেল ৪টার দিকে কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। কারাগারে বাইরের গেটে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে মিনু আক্তার বলেন, মর্জিনা নামে একজন সিতাকুন্ডের ছিন্নমূল এলাকা থেকে চাল-ডাল ও টাকা দেওয়ার কথা বলে আমাকে নিয়ে আসছে। এরপর তারা যা বলছে তাই করেছি। এরপর থেকে আমি জেলে ছিলাম।
তিনি বলেন, আমি কাউকে ক্ষতি করি নাই, এমনকি কাউকে মারিও নাই। এরপরও আমাকে জেলে থাকতে হয়েছে। যাদের কারণে বিনাদোষে জেল খাটতে হলো আমি তাদের দোষীদের বিচার চাই। ভালোভাবে বাঁচতে চাই।
কারাগারের সামনে মিনু আক্তারের ভাই মোহাম্মদ রুবেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বোনকে যাকাত ও টাকা দেওয়ার কথা বলে আদালতে নিয়ে আসছে। এগুলো আমরা জানতাম না। কুলসুম ও মর্জিনা নামে দুই জন মিলে এই কাজটা করছে। মর্জিনা ও কুলসুম আগে ছিন্নমূল থাকত। আমাদের পাশেই থাকত তারা। ওখান থেকেই পরিচয় আমার বোনের সঙ্গে তাদের। তারপর একদিন হঠাৎ করেই আমার বোনকে নিয়ে আসে তারা। কিছুদিন বোনের খোঁজ পায়নি। এরপর হঠাৎ একদিন শুনতে পাই বোন জেলখানায়। পরে জেলখানায় দেখা করি। কিন্তু আমাদের আদালতে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। পরে এ আইনজীবীর মাধ্যমে আমার বোন আজকে মুক্তি পেয়েছেন। এতে খুব আনন্দিত আমরা।
তিনি আরও বলেন, আমার নিরাপদ বোনকে যারা কারাগারে পাঠিয়ে তিন বছর জেলে রেখেছে, তাদের শাস্তি যেন হয়। সরকারের কাছে আবেদন তাদের যেন শাস্তি হয়। কুলসুম ও মর্জিনা এখন আর ছিন্নমূল এলাকায় থাকেন না বলেও জানান রুবেল।
মিনু আক্তারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আজ বিকেল ৪টার দিকে কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। পরে স্বজনদের সঙ্গে ছিন্নমূল এলাকায় ভাইদের বাসায় ফিরে যান মিনু।
তিনি আরও বলেন, সহজ সরল মিনু আক্তারকে যাকাতের কাপড় ও টাকা দেওয়ার কথা বলে নিয়ে এসেছিল কুলসুম ও মর্জিনা। শুধু মাত্র কুলসুম আক্তার বলে কেউ ডাকলে মিনু যেন হাত তুলেন, একথাও শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আইনজীবী মুরাদ বলেন, জেলখানায় তো আসামিদের শুধু নাম ধরে ডাকে। কারগারের ভেতরে কুলসুমা আক্তার বলে ডাকার পর মিনু হাত তোলে। এরপর তাকে কারাগারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
এই আইনজীবী আরও বলেন, ঘটনাটি প্রায় তিন বছর পর আমাদের নজরে আসে। তারপর আমরা জেলখানা কর্তৃপক্ষ ও আদালতকে জানাই। প্রথমে কারাগার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। পরে আদালতকে জানানোর পর আদালত প্রথম আসামি কুলসুমের ছবি ও মিনুর ছবিসহ বালাম বই তলব করেছিল। তলব করার পর ধরা পড়েছে মিনু আক্তার কুলসুমা বেগম নয়। দুইজন পৃথক ব্যক্তি। পরে চট্টগ্রামের আদালত বিষয়টি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেয়। পরে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের সন্তুষ্টিতে মুক্তি দেওয়ার আদেশ দেন। আর আজকে আদালতে আদেশে মিনু আক্তার মুক্তি পেলো।
গোলাম মাওলা মুরাদ আরও বলেন, তিন বছর ধরে একজন নারী বিনা আপরাধে জেল খেটেছেন। এর দায়িত্ব কে নেবে। এই ঘটনায় পেছনে যারা রয়েছেন তাদের শাস্তি দাবি করছি এবং বিষয়টি আদালতে জানিয়েছি। যারা নিরপরাধ হয়ে জেল খাটছে তাদের যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, সে জন্য আদালতে রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
মিনু আক্তারের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, আদালত আজকে মামলার মূল আসামি কুলসুমা আক্তারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। পাশাপাশি পুলিশকে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে হাইকোর্টের আদেশের পরে মিনু আক্তারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ চট্টগ্রাম আদালতে তার মুক্তির জন্য আবেদন করেন।
বুধবার (১৬ জুন) দুপুরে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালত মিনুকে মুক্তির আদেশ দেন।
আদালত সূত্র জানায়, মোবাইল ফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পোশাককর্মী কোহিনুর বেগমকে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর এ মামলার রায়ে আসামি কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। রায়ের দিন কুলসুম আদালতে অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তার মামলার সাজা হওয়ার আগে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। সাজা ঘোষণা হওয়ার পর ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুম সেজে মিনু আক্তার কারাগারে আসেন। চলতি বছরের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের পক্ষ থেকে আদালতে একটি আবেদন করা হয়। এই আবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে কারাগারে পাঠানো আসামির সঙ্গে প্রকৃত আসামির মিল নেই। এছাড়া কারা রেজিস্ট্রারে থাকা দুজনের ছবির মিল নেই।
এ আবেদনের শুনানি শেষে কারাগারে থাকা মিনুকে আদালতে হাজির করে তার জবানবন্দি নেওয়া হয়। তখন তিনি জানান, তার নাম মিনু, তিনি কুলসুম নন।
আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারগুলো দেখে হাজতি আসামি কুলসুম ও সাজাভোগকারী আসামির চেহারায় অমিল খুঁজে পান। তখন আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারসহ একটি নথি হাইকোর্ট বিভাগে আপিল নথির সঙ্গে সংযুক্তির জন্য পাঠিয়ে দেন।
পরে হাইকোর্ট গত ৭ জুন নিরপরাধ মিনুকে মুক্তির নির্দেশ দেন।
কেএম/এসএম