করোনা মোকাবিলায় সরকারি ব্যয়ে দুর্নীতি অব্যাহত : টিআইবি
বিভিন্ন হাসপাতালের কোভিড মোকাবিলায় বরাদ্দ ব্যয়ে দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে। করোনা মহামারির গত চার মাসে ৫টি হাসপাতালের ক্রয়, শ্রমিক নিয়োগ ও কোয়ারেন্টাইন বাবদ ৫ কোটি টাকার দুর্নীতি তথ্য মিলেছে।
উপযোগিতা যাচাই না করে হাসপাতাল নির্মাণ এবং তার যথাযথ ব্যবহার না করে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ায় ৩১ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। কোভিড-১৯ টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় বিধি অনুসরণ করা হয়নি।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (৮ জুন) ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলা: কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সভাপতি হিসাবে সংযুক্ত ছিলেন। সংস্থাটির রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণাপত্র তৈরি করা হয়েছে।
টিআইবির গবেষণা বলছে, বিভিন্ন হাসপাতালের কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বরাদ্দ ব্যয়ে দুর্নীতি অব্যাহত: ৫টি হাসপাতালে ক্রয়, শ্রমিক নিয়োগ ও কোয়ারেন্টাইন বাবদ ৬২ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। যার মধ্যে রয়েছে, ক্রয় বিধি লঙ্ঘন করে এক লাখ কিট ক্রয়; দর প্রস্তাব মূল্যায়ন, আনুষ্ঠানিক দর-কষাকষি, কার্য সম্পাদন চুক্তি, কার্যাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধি লঙ্ঘন ও অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়াদেশ দেওয়া। অভিযোগ রয়েছে করোনাকালে কারিগরি জনবল ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়োগে জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যেরও।
গবেষণায় দুর্নীতির আরও তথ্যের মধ্যে রয়েছে, টিকার আনুষঙ্গিক উপকরণ ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়াদেশ দেওয়া। কোনো হাসপাতালে শয্যা খালি নেই, আবার কোনো হাসপাতালে রোগী নেই; উপযোগিতা যাচাই না করে হাসপাতাল নির্মাণ এবং তার যথাযথ ব্যবহার না করে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ায় ৩১ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে।
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির তথ্য পাওয়া গেছে। যেমন-স্বাস্থ্যখাতের ক্রয়ে সংগঠিত দুর্নীতির কারণে বার বার পরিচালক পরিবর্তন; ধীরগতির তদন্ত কার্যক্রমের প্রভাবে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি।
অনিয়মের মধ্যে আরও রয়েছে, অনেক কোভিড-ডেডিকেটেড হাসপাতাল বন্ধ; আইসিইউসহ চিকিৎসা সংকট করোনা সংক্রমণের একবছর তিনমাস পার হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি চিকিৎসা সুবিধার সম্প্রসারণ না করা বাজেট এবং যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও সব জেলায় ১০টি করে আইসিইউ শয্যা প্রস্তুতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করা, অনেক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করে ফেলে রাখা, সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সংকটের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি। যে কারণে অনেক কোভিড-১৯ রোগীকে গড়ে ৫ লক্ষাধিক টাকা খরচ করতে হয়েছে।
সরকারি ক্রয়ে আইন অনুসরণে ঘাটতি
কোভিড-১৯ টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় বিধি অনুসরণ করা হয়নি বলে মনে টিআইবি। কারণ হিসেবে টিআইবির ব্যাখ্যায় বলা হয়, টিকা ক্রয় পরিকল্পনা ও চুক্তি সম্পাদন নোটিশ সিপিটিউ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি এবং একটি উৎস থেকে ক্রয়ের ক্ষেত্রে দর-কষাকষির নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। আর এই সবই সরকারি ক্রয় বিধি, ২০০৮ এর ১৬ (১১), ৩৭ (১), ১২৬ (৩), ৭৫ (৩) বিধির লঙ্ঘন। যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ (২.১৯ ডলার), ভারত (২.৮ ডলার), আফ্রিকান ইউনিয়ন (৩ ডলার) এবং নেপালের (৪ ডলার) চেয়ে বেশি মূল্যে টিকা ক্রয় (৫ ডলার) করা হয়েছে। খরচ বাদে তৃতীয় পক্ষের প্রতি ডোজ টিকায় প্রায় ৭৭ টাকা করে মুনাফা হিসেবে প্রথম ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহে ৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। এভাবে তিন কোটি ডোজে তাদের মোট লাভ হবে ২৩১ কোটি টাকা।
এছাড়া ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান একজন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। এছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, যা আইনের লঙ্ঘন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ [অনুচ্ছেদ ১২ (কে)] অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে এমন কেউ সংসদ সদস্যপদে থাকতে পারবে না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা, নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় প্রণোদনা বিতরণে যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতিসহ সমন্বয়হীনতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে। কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমেও সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকে ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। আইনের লঙ্ঘন করে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় টিকা আমদানির মাধ্যমে জনগণের টাকা হতে তৃতীয় পক্ষের লাভবান হওয়া সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কৌশলগত ঘাটতি, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব ও রাজনৈতিক বিবেচনায় টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে একক উৎসের ওপর নির্ভর করার কারণে চলমান টিকা কার্যক্রমে আকস্মিক স্থবিরতা নেমে এসেছে।
আরএম/এসএম