আগুনে শুধু ঘর পোড়ে না, পোড়ে না শুধু বস্তি; পোড়ে অনেক স্বপ্ন, অনেক সাধ। তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন যখন পুড়ে যায় চোখের পলকে, তখন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তেমনই তাকিয়ে ছিলেন নান্টু মিয়া। চোখের সামনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন আগুন নেভাচ্ছে, কাঠকয়লার ভিড়ে তখন ভাসছে নান্টুর পোড়া স্বপ্ন। 

এই চিত্র সোমবার (৭ জুন) ভোরের; রাজধানীর মহাখালী সাততলা বস্তির। যেখানে পাঁচ বছরের ঘামে-শ্রমে-প্রেমে তিলে তিলে নান্টু মিয়া বুনেছিলেন কুটির শিল্পের স্বপ্ন। ফুলদানি, খেলনা, পাপস, জায়নামাজ, ঝুড়ি তৈরি করে বিক্রি করেন তিনি। আর স্বপ্ন দেখেন বড় কিছু করার। এই স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখা নয়, বরং এই স্বপ্নই তাকে ঘুমাতে দেয় না। কঠোর পরিশ্রমে ধীরে ধীরে স্বপ্ন পূরণের দুয়ারে প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলেন নান্টু। কিন্তু সর্বনাশা আগুন দপ করে বন্ধ করে দিলো তার স্বপ্নের দুয়ার। আগুনে পোড়া বাতাসে নান্টু মিয়া অনুভব করেন, আকাশের ওপারে থাকা ভাগ্য নিয়ন্তা (ঈশ্বর) তাদের সঙ্গে এই বস্তিতে থাকেন না, তিনি থাকেন ‘ওই ভদ্রপল্লীতে’! 

ভুক্তভোগী নান্টু মিয়া

কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা নান্টু মিয়ার বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এই জায়গায় পাঁচ বছর থাকি। আমার পাঁচ বছরে তিলে তিলে গড়া কুটির শিল্পের ব্যবসা। নিজেরাই বাস্কেট, ফুলদানি, খেলনা, পাপস, জায়নামাজ তৈরি করি। মহাখালীতে বিক্রি করি। বড় একটা কুটির শিল্পের কারখানা গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে সপরিবারে কষ্ট করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সব কষ্ট পানিতে গেল। এই ভোরের আগুন আমার সব কেড়ে নিয়েছে। মাল-সামানা, কাঁচামাল, নগদ পুঁজি- সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

বলতে বলতে গলা ধরে আসে সব হারানো নান্টুর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার প্রশ্ন- ‘গরিবের কপাল এভাবে কেন পোড়ে ভাই?’ বলেন, ‘কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা আর নেই।’

নান্টু মিয়া জানান, করোনার মধ্যে দুই লাখ টাকার মাল কেনেন তিনি। আগুন লাগার রাতে বাসায় তার এক লক্ষাধিক নগদ টাকা ছিল। মহাখালীতে একটা শো-রুম দেওয়ার জন্য এই টাকা জমিয়েছিলেন। কিন্তু আগুন তার সব শেষ করে দিলো। ঘরের আসবাবপত্র-ব্যবসার মালামাল কিছুই বের করতে পারেননি তিনি।

সোমবার ভোর ৪টার দিকে সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৮টি ইউনিট কাজ করে। অগ্নিকাণ্ড শুরুর আড়াই ঘণ্টা পর সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

বস্তিবাসীরা জানান, বস্তির পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের গ্যাসের লাইন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রথমে বালি চাপা দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন বাসিন্দারা। এতে আগুন না নিভে বরং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বস্তির উত্তর-পূর্ব দিকে। আগুনে পুড়ে যায় দেড় শতাধিক ঘর। 

ছবি- সুমন শেখ

অধিকাংশ বাসিন্দার দাবি, আগুনে তাদের সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষই সন্তান কোলে এক কাপড়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়েছেন জীবন রক্ষার তাগিদে।

পুড়ে কয়লা হওয়া ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলেন পটুয়াখালীর বাউফলের কোহিনূর বেগম। তার স্বামী হারুন রিকশা চালান। কোহিনূর বাসাবাড়িতে কাজ করেন। শাশুড়ি, সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে তার আট সদস্যের সংসার। রাতে সবাই এক সাথেই ঘুমিয়েছিলেন। সকালে দেখলেন পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই তাদের। 

আগুনে জল শুকালেও অশ্রু শুকায় না/ ছবি- সুমন শেখ

কোহিনূর বলেন, আগুন থেকে নিজে বাঁচমু নাকি মাল-সামানা রক্ষা করমু? আগুনে সব শেষ, টাকা পয়সা, কিচ্ছু কওনের নাই। সারা জীবন কষ্ট করেই গেলাম। আল্লাহ তাও কাইড়া নিল! 

তিনি বলেন, আগুন লাগলে শুধু জানডা নিয়ে বের হইছি। কিচ্ছু বের করতে পারি নাই ঘর থেইকা। সব পুড়ে গেছে। সমিতি থেইকা নেওয়া ঋণের কিস্তি দিতে আট হাজার টাকা রাখছিলাম, সেইডাও পুড়ছে। 

ছবি- সুমন শেখ

আগুনের খবরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, অবৈধ গ্যাস ও বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, বস্তিতে টিনের ঘর অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আমাদের ১৮টি ইউনিট কাজ করেছে। এখন পর্যন্ত আগুনে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে বলে আমরা ধারণা করছি। ঘরে থাকা আসবাবপত্রও পুড়ে গেছে। 

ছবি- সুমন শেখ

আগুনের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে প্রচুর পরিমাণে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, এই দুটির যেকোনো একটির কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। ঘনবসতির কারণে এবং দাহ্য বস্তু বেশি থাকায় আগুন বেশি ছড়িয়েছে।

থেমে থাকে না জীবন সংগ্রাম/ ছবি- সুমন শেখ

২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট পাঁচ বার পুড়েছে সাততলা বস্তি। ২০১২, ২০১৫, ২০১৬ ও ২০২০ সালে আগুন লাগে এখানে। প্রতিবারই গ্যাস অথবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।

আজকের অগ্নিকাণ্ডও অবৈধ গ্যাস সংযোগের লিকেজ থেকে হয়েছে বলে দাবি বাসিন্দাদের। এ বিষয়ে সাততলা বস্তির বাসিন্দা শফিয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে বস্তির দক্ষিণ পাশে একটি ঘরে রান্নার কাজ চলছিল। চুলা থেকে হঠাৎ করে গ্যাস লিকেজ হয়ে আগুন ছড়ি পড়ে সারা ঘরে। আগুন লাগার পর ঘরের মানুষজন আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করলে কোনো মতে জীবনটা নিয়ে বের হই। 

ছবি- সুমন শেখ

বস্তির আরেক বাসিন্দা ইয়ামিন হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাগো বস্তির সব থেকে খারাপ জিনিস হইল গ্যাসের লাইন। দুই দিন পর পর শোনা যায় বস্তির ভেতরে ওই জায়গায় গ্যাস লিকেজ হইছে, ওই ঘরের গ্যাস লাইন থেকে গ্যাস বের হচ্ছে। পরে যারা গ্যাস দিয়েছে তাদের জানাইলে তারা আইসা কোনোমতে প্লাস্টিক দিয়া জোড়াতালি দিয়ে লিকেজ বন্ধ কইরা যায়। পরে আবার সেই প্লাস্টিক উইঠা গেলে আবারও লিকেজ শুরু হয়। 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে সাততলা বস্তি। তারা কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছে বস্তিতে। প্রতিটি ঘর থেকে গ্যাস সংযোগবাবদ চক্রটি ১ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। বস্তির প্রায় ১ হাজার ঘর থেকে টাকা তুলছে তারা। 

শেষরাতের আগুন কেড়েছে ঘরসহ সব জিনিসপত্র। কীভাবে চলবে জীবন? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে কোলের ছোট্ট এই শিশুটিও/ ছবি- সুমন শেখ

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বস্তিটি পরিচালিত হয় স্থানীয় রাজনৈতিক লোকদের দ্বারা। যখন যে দলের সরকার থাকে তখন সেই দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা বস্তিটি নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই মূলত বিদ্যুৎ অফিস ও তিতাস গ্যাসের সঙ্গে যোগসাজশ করে আমাদের বস্তিতে অবৈধ সংযোগ দেয়। মাঝে মধ্যেই গ্যাস লাইনে লিকেজ হয়। আমরা খবর দিলে স্থানীয় নেতারা ম্যাকানিক এনে রাবার দিয়ে লাইন ঠিক করে যায়। বারবার আগুন লাগায় গ্যাস লাইনের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি করলে তারা নিজেদের গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে আমাদের হুমকি দেয়। আবার অনেক সময় মারধরও করে। বস্তিবাসী অধিকাংশই খেটে খাওয়া মানুষ। ভয়ে কেউ কিছু বলেন না। আর সরকারের পক্ষ থেকেও এখানে কেউ আসে না অবৈধ গ্যাস সংযোগের খোঁজ নিতে।

জেইউ/এইচকে/জেএস