‘প্রতিশ্রুতিতেই’ সীমাবদ্ধ জলাবদ্ধতা নিরসন
ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা দীর্ঘ দিনের। প্রত্যেক বর্ষা মৌসুমেই জলজটে নাকাল হতে হয় নগরবাসীকে। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় পুরো শহরের রাস্তাঘাট। তখন আলোচনায় আসে ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ ও নিরসনের উপায়।
জলাবদ্ধতা থেকে দ্রুতই মুক্তি মিলবে বলে প্রতি বছর আশ্বস্ত করা হয় দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু বাস্তব কাজের অগ্রগতি নিয়ে সংশয় রয়েছে সাধারণ মানুষের মনে।
বিজ্ঞাপন
শনিবার ( ৫ জুন) সকাল থেকে রাজধানীতে ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতে মিরপুর, ধানমন্ডি, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, মগবাজার, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় যানজটের। এতে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। এর আগে গত ১ জুন প্রায় তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে তীব্র জলজটের সৃষ্টি হয় রাজধানীতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা রাজধানীর সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে ‘বহুলাংশে’ মুক্তি দেবে বলে আশ্বস্ত করে। কিন্তু গত ১ জুন ও আজকের (৫ জুন) বৃষ্টিতে সংস্থা দুটির দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি পায়নি ঢাকাবাসী।
নগরবাসী বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের আশা দেখিয়েও কথা রাখতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন বলছে, জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ খালগুলোর অবৈধ দখল। অধিকাংশ খাল দখল হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহ ঠিক না থাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে আরও সময় লাগবে।
প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। বৃষ্টি হলেই নগরীর অলিগলি ও ছোট পরিসরের রাস্তাগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। রাজধানীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকায় দ্রুত পানি নামতে পারে না, ফলে প্রতিবারই এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সামান্য বৃষ্টিতেই মতিঝিল, গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মালিবাগ, রামপুরা, পুরান ঢাকা, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
রাজধানীর মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান বলেন, প্রতি বর্ষা মৌসুমে আমাদের সড়কে হাঁটু সমান পানি থাকে। এবার যখন ঢাকার সব খাল নালার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়া হলো তখন সিটি করপোরেশনের মেয়ররা জলাবদ্ধতা নিরসনের নানা উদ্যোগের কথা জানান। কিন্তু গত ১ জুন আর আজকের বৃষ্টিতে তাদের সব কথা ভেসে গেছে। তারা শুধু আশা জাগিয়েছিলেন। এখন আরও সময় চাচ্ছেন তারা।
কেন জলাবদ্ধতা থেকে মিলছে না মুক্তি?
ঢাকা মহানগরীতে প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। আর শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে ও প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আসছিল। কিন্তু গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের হাতে ছিল। এরপর পৌরসভা এ দায়িত্ব পালন করত। ১৯৮৮ সালে এটি ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়।
ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পর খালগুলো দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। পাশাপাশি খালগুলোর শাখা-প্রশাখা, বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যা পুরোপুরি শেষ হতে আরও সময় লাগবে বলে দাবি দুই সিটি করপোরেশনের। নির্ধারিত কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা থেকে রাজধানীবাসীকে বহুলাংশে রক্ষা করা যাবে বলে আশা কর্তৃপক্ষের।
খালগুলোর দায়িত্ব পাওয়ার পর কেন জলাবদ্ধতা কমছে না এ বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর ২ জানুয়ারি থেকে জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর, কালুনগরসহ খালগুলোর শাখা-প্রশাখা এবং পান্থপথ ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট থেকে আমরা বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে এসব খাল ও বক্স কালভার্ট থেকে ১ লাখ ৩৫০০ টনের বেশি বর্জ্য ও ৬ লাখ ৭৯ হাজার টন পলি অপসারণ করেছি। এছাড়াও ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে পাওয়া অচল দুটি পাম্প স্টেশনের তিনটি পাম্প মেশিন সচল করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি তিনটি সচল করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও ওয়াসার কাছ থেকে পাওয়া বন্ধ নর্দমা ও আমাদের উন্মুক্ত নর্দমাগুলো পরিষ্কারের কাজ চলমান। চলতি মাসের মধ্যেই তা শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কাজগুলো শেষ হলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা অনেকাংশেই কমে যাবে। আগামী ২ বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতাকে একটি সহনীয় মাত্রায় আনতে সক্ষম হবো।
এদিকে গত (২ জুন ) এক অনুষ্ঠানে জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে মেয়র তাপস বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আগামী দুই মাস আমাদের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মাঠে থাকবেন। যেখানেই জলাবদ্ধতা দেখা দেবে সেখানেই দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএসসিসি তার নিজস্ব অর্থায়নে ১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য সাধারণ বৃষ্টিপাত হলে যাতে ঢাকা শহরে পানি না জমে সে কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা। এছাড়া ভারী বৃষ্টি হলে যেন তিন ঘণ্টার মধ্যে সব পানি নেমে যেতে পারে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি আমরা।
অন্যদিকে দায়িত্ব নেওয়ায় পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতায় থাকা খাল থেকে ১১ হাজার ৬৩৮ টন ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। খালের তলদেশ থেকে অপসারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ টন কঠিন বর্জ্য। বর্তমানে খালগুলোয় পানি প্রবাহ সচল রয়েছে। পানি প্রবাহ আরও বৃদ্ধির জন্য কাজ চলমান রয়েছে। মোট ২১ হাজার ৮৪৩ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী খাল পরিষ্কারে কাজ করছেন। পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসা থেকে পাওয়া ১৮০ কিলোমিটার স্ট্রর্ম স্যুয়ারেজ ড্রেনের মধ্যে ৯৪.৭১ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কারের জন্য ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি আঞ্চলিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে ডিএনসিসি।
ডিএনসিসি এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে মগবাজার, মধুবাগ, কারওয়ান বাজার, উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরসহ এয়ারপোর্ট রোড এবং বনানী রেলগেট থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ ও পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়া ইব্রাহিমপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, আব্দুল্লাহপুর খিজির খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে।
শনিবার (৫ জুন) এক অনুষ্ঠানে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জলাবদ্ধতার বিষয়ে বলেন, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ডিএনসিসি বিভিন্ন জায়গায় খাল উদ্ধার ও পরিষ্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। জনগণের সহায়তায় তা অব্যাহত থাকবে। গত ১ জুন ঢাকায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নগরবাসীকে জলজট থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আরও ১৭টি খালের দায়িত্ব পাচ্ছে সিটি করপোরেশন
ইতোমধ্যে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ২৬টি খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর বাইরে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে থাকা রাজধানীর ১৭টি খাল রয়েছে। এই খাল ও জলাশয়গুলো দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত ১৮ মে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা মহানগরীর খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ কথা জানান স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। এ সময় তিনি বলেন, হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ, সংস্থা ও দফতরের প্রতিনিধি নিয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি একটি রিপোর্ট প্রদান করবে। রিপোর্ট অনুযায়ী হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
এএসএস/এসকেডি