সাবিরা রহমান লিপি

রাজধানীর গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক সাবিরা রহমান লিপি (৪৬) হত্যার ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও খুনিকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এখন পর্যন্ত তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে হত্যার ঘটনা ‘ক্লুলেস’। নিহত চিকিৎসকের ভাড়া বাসার আশপাশে কোনো সিসিটিভি নেই। ছয় বাড়ি পরের একটি সিসিটিভির ফুটেজ পুলিশ সংগ্রহ করলেও তাতে কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাক্তার সাবিরা হত্যাকাণ্ডে পরিবারের কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কারো সঙ্গে শত্রুতা বা রেষারেষি ছিল কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অন্তত ১৪/১৫ জন পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। যদিও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি এখনো হয়নি।

গত সোমবার (৩১ মে) সকালে কলাবাগান ফার্স্ট লেনের ৫০/১ ভাড়া বাসা থেকে চিকিৎসক সাবিরার রক্তাক্ত ও দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের কনসালটেন্ট (সনোলজিস্ট) ছিলেন।

চিকিৎসক কাজী সাবিরার মরদেহ উদ্ধারের ৩৫ ঘণ্টা পর রাজধানীর কলাবাগান থানায় হত্যা ও হত্যার আলামত নষ্টের চেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন ডা. সাবিরার মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল। মামলায় আসামির নাম অজ্ঞাত উল্লেখ করলেও বাদীর সন্দেহ চিকিৎসক লিপির ভাড়া বাসার সাবলেটে থাকা শিক্ষার্থী ও মডেল কানিজ সুবর্ণাকে ঘিরে।

মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, আমার বোনের মরদেহ দেখে এবং ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, গত ৩০ মে রাত আনুমানিক ১০টা থেকে পরদিন ৩১ মে সকাল ১০টার মধ্যে অজ্ঞাতনামা আসামিরা আমার বোন ডাক্তার লিপিকে কলাবাগান থানার ফার্স্ট লেনের ৫০/১ নং বাসার তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে ছুরিকাঘাত ও তীক্ষ্ণ অস্ত্রের দ্বারা গলাকেটে হত্যা করে। হত্যার ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এবং হত্যার আলামত নষ্ট করতে শরীরে ও বিছানায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় ওই অজ্ঞাত আসামিরা।

এজাহারে বাদী লেখেন, এই খুনের সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে সাবলেটে থাকা কানিজ সুবর্ণা অথবা অন্য কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে মর্মে আমার দৃঢ় সন্দেহ হয়। তবে সাবলেটের অপর বাসিন্দা নূরজাহান গ্রামের বাড়িতে থাকায় তাকে সন্দেহ করার কথা বলেননি তিনি। 

একটি সূত্রে জানা গেছে, কানিজ সুবর্ণা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে মডেলিংয়ের পাশাপাশি দারাজ অনলাইনে কাজ করেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কানিজ সুবর্ণা চিকিৎসক সাবিরার ভাড়া বাসায় সাবলেটে ওঠেন। সাবিরার মরদেহ উদ্ধারের পর তাকে ডিবি পুলিশ হেফাজতে নেয়।

তবে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চিকিৎসক সাবিরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মডেল কানিজের সম্পৃক্ততা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ওই বাসায় দীর্ঘদিন থাকার কারণে ডাক্তার সাবিরার বাসায় কে কে যাতায়াত করতেন তিনি তা জানতেন। যদিও হত্যাকাণ্ডের আগে রোববার রাত ১০টার দিকে বা তারও আগে চিকিৎসক সাবিরার কাছে কে কে এসেছিলেন তা কানিজ দেখেননি বলে দাবি করেছেন।

এ বিষয়ে পুলিশের কলাবাগান থানার ওসি পরিতোষ চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, থানায় মামলা হয়েছে। আমরা তদন্তের মাধ্যমে খুনিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। চিকিৎসক সাবিরাকে কে কীভাবে কেন হত্যা করল সেটা বলার মতো তেমন কোনো অগ্রগতি এখনো হয়নি। সাবলেটের কানিজকে খুনি বলার মতো কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তবে বাদী সন্দেহ করতেই পারেন। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই আমরা খুনিকে শনাক্তের চেষ্টা করছি।

বুধবার (২ জুন) রাতে রমনা বিভাগের কলাবাগান জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‌পুলিশের সন্দেহে পরিচিত ও আত্মীয়-স্বজন সবাই আছে। প্রয়োজন অনুযায়ী ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত ঘটনার কূল-কিনারা করা সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, কে হত্যা করল, কেন হত্যা করল, কারা ওই বাসায় যাতায়াত করত, পরিবারের সঙ্গে নিহত চিকিৎসকের দূরত্ব ছিল কি না সেটা জানার চেষ্টা করছি। এখানে দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা হত্যাকাণ্ডের ভবন ও আশপাশের কোনো সিসিটিভি ফুটেজ পাইনি। একটু দূরের যে ফুটেজ পুলিশ উদ্ধার করেছে তাতে আমলযোগ্য কিছু মেলেনি। তবে থানা পুলিশের পাশাপাশি সব সংস্থাই কাজ করছে। আশা করছি দ্রুতই হত্যার মোটিভ উদঘাটন সম্ভব হবে এবং খুনি গ্রেফতার হবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্তকারীরা হত্যাকারীকে শনাক্তে নিহতের মরদেহ ও ঘরের দরজাসহ সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানের ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ করেছে। নিকটাত্মীয় ও সন্দেহভাজনদের ফিঙ্গারপ্রিন্টও সংগ্রহ করা হচ্ছে।

গত সোমবার (৩১ মে) কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের ডাক্তার সাবিরার ভাড়া বাসায় প্রথমে আগুনের খবরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে যায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গিয়ে বাসায় আগুনের ধোঁয়া দেখতে পান। নিহত চিকিৎসকের শরীরের কিছু অংশ দগ্ধ ছিল বলে জানান তারা। মরদেহ উদ্ধারের পর পিঠে দুটি ও গলায় একটি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পায় পুলিশ।

খবর পেয়ে সোমবারই ঘটনাস্থলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। আলামত সংগ্রহের পর ক্রাইম সিন ইউনিট জানায়, সাবিরাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দাহ্য পদার্থ না থাকায় আগুন তেমন ছড়ায়নি। তবে, সাবিরার শরীরের কিছু অংশ এতে দগ্ধ হয়।

সেসময় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের ইন্সপেক্টর শেখ রাসেল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাবিরার শ্বাসনালী কেটে ফেলা হয়েছে। তার দেহে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও পোড়ার ক্ষত আছে। আমরা আপাতত নিশ্চিত হয়েছি, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। আলামত দেখে মনে হয়েছে, মধ্যরাতে কোনো এক সময় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে।’

জেইউ/ওএফ/জেএস