সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের খবরে আলোচনায় আসা রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়ের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সর্বনাশ হয়েছে আরও এক কিশোরীর। 

আগের ঘটনার ওই তরুণীর মতো এই কিশোরীকেও পাচার করা হয় ভারতে।  টিকটকে ‘স্টার’ বানানোর কথা বলে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে কৌশলে ভারতে পাচার করা হয় তাকে। ভারতে পাচারের শিকার ওই কিশোরী তিন মাসের নির্মম নির্যাতন ও বন্দিদশা থেকে পালিয়ে সম্প্রতি দেশে ফেরেন। 

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ওই কিশোরী হাতিরঝিল থানায় একটি মামলাও দায়ের করেছেন। কিশোরী বলছেন, ২০১৯ সালে হাতিরঝিলে মধুবাগ ব্রিজে হৃদয়ের সাথে পরিচয় হয় তার।  

ভারতে পাচারের পর ওই কিশোরীকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। সেখানে তিনি ওই চক্রটির দ্বারা পাচারের শিকার আরও কয়েকজন বাংলাদেশি তরুণীকে সেখানে দেখতে পান। যাদের সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে। 

গ্রেফতার হওয়া মেহেদি, মহিউদ্দিন ও কাদের

পালিয়ে দেশে ফেরা ওই কিশোরীর করা মামলার এজহারে ও তদন্তে উঠে এসেছে রোমহর্ষক বর্ণনা। মামলায় এজাহারনামীয় ১২ আসামির মধ্যে ৫ জন বাংলাদেশি, ৭ জন ভারতীয়। ৫ বাংলাদেশির মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ পুলিশ।

যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেন- মেহেদি হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের। বুধবার সকালে নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ।

তিনি বলেন, ২০১৯ সালে পরিচয়ের পর কখনও টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে, কখনও ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে ওই কিশোরীকে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করেন হৃদয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে ‘টিকটক হ্যাংআউট’ এবং ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করেন এই হৃদয়। 

২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় লালন শাঁইয়ের মাজারে ‘টিকটক হ্যাংআউটে’ নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ওই কিশোরীকে ভারতে পাচার করা হয়।

ওই তরুণী পুলিশকে জানিয়েছেন, ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছানোর কয়েকদিন পরই তাকে চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতন করা হয় তাকে। কৌশলে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য ও পরিচিতদের তা পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল তাকে। 

পাচার হওয়া আরও দুই ভুক্তভোগী পালিয়ে ফিরেছেন
এই কিশোরী ছাড়াও পাচারের শিকার আরও দু’জন ব্যাঙ্গালুরুতে অবস্থিত আস্তানা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের নাম-ঠিকানা জেনে যোগাযোগের চেষ্টা করছে পুলিশ।

চক্রে জড়িত ৫ বাংলাদেশি
ডিসি শহীদুল্লাহ বলেন, এই কিশোরীকে পাচারের ঘটনার সাথে ১২ জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য আমরা পেয়েছি। টিকটক হৃদয় ও গ্রেফতার তিনজন একই চক্রের সদস্য। তাদের মধ্যে ৫ জন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। বাকি সাত জন ভারতীয় বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে।

গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে ওই তিন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। 

পুলিশ বলছে, গ্রেফতার মেহেদী হাসান বাবু স্বীকার করেছেন যে তিনি এক হাজারের বেশি নারী পাচারে জড়িত। 

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছে পুলিশ

৭/৮ বছর ধরে পাচারে জড়িত মেহেদি হাসান বাবু
মেহেদি হাসান বাবু প্রায় ৭-৮ বছর ধরে মানবপাচারে জড়িত। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা মোবাইল ও ডায়েরিতে হৃদয়, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। পাশাপাশি তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ডায়েরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ঘটনার তরুণীর আধার কার্ড নম্বর পাওয়া ওগেছে। এছাড়া ভারতে পাচার করাদের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।

গ্রেফতার অন্য দুজন মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের ওই কিশোরীকে ভারতীয় দালালের হাতে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বলেও দাবি করেন ডিসি শহীদুল্লাহ।

পাচারের শিকার ও পাচারকারীরা কিভাবে ভারতে যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাচারের শিকার ও পাচারকারীরা অবৈধভাবে ভারতে যায়। এরপর অবশ্য চক্রের ভারতীয়দের সহায়তায় আধার কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়। আধার কার্ড থাকলে ভারতে মুভমেন্ট করা যায়।

জেইউ/এনএফ