দুই বছরেও উদ্ধার হয়নি ডাচ-বাংলার ছিনতাই হওয়া সোয়া ৩ কোটি টাকা

২০২৩ সালের ৯ মার্চ রাজধানীর উত্তরার তুরাগ এলাকায় ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১২ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ৮ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং ছিনতাইয়ের ২০ লাখ টাকায় কেনা একটি গাড়িও। ওই ঘটনায় অবশিষ্ট প্রায় ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ও আপর দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়নি পুলিশ। এ অবস্থায় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি আদালতে  মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে তদন্তকারী মিরপুর গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ।

এদিকে, মামলার এজাহারে ডিবি পুলিশ উল্লেখ করেছে, মানি প্ল্যান্ট লিংক লিমিটেড নামের একটি সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে করে ওই টাকা বহন করা হচ্ছিল। বুথে টাকা লোড করতে ঢাকা থেকে সাভার ইপিজেড যাচ্ছিল গাড়িটি। পথে একদল ডাকাত একটি মাইক্রোবাস আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে টাকা বহনকারী গাড়িটি থামায়। এরপর মাইক্রোবাস থেকে ১০-১২ জন সশস্ত্র ব্যক্তি নেমে গাড়ির দরজা খুলে ফেলেন। তাদের একজন নিজেকে ডিবি পরিচয় দেন।

ডাকাতেরা মানি প্ল্যান্টের কর্মীদের চড়-থাপ্পড় ও ঘুষি মেরে টাকাভর্তি চারটি ট্রাংক ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। ট্রাংকে সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিল। টাকা বহনের সময় নিয়ম অনুযায়ী সিকিউরিটি কোম্পানির কর্মীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না। এ ঘটনায় মানি প্ল্যান্ট লিংক লিমিটেড সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে তুরাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। শুরু থেকেই ডাকাতির মামলাটির ছায়া তদন্ত করে আসা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগের হাতে পরে ঘটনার তদন্তভার ন্যস্ত করা হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনাটি তখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এতে ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধারাবাহিক অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ১৩ জনকে। ওই ঘটনায় উদ্ধার করা হয় ৮ কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা।

মামলায় গ্রেপ্তার যারা

সোহেল রানা শিশির ওরফে রানা ওরফে সোহেল রানা, মো. আকাশ আহম্মেদ বাবলু ওরফে বাবলু মিয়া, হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব ওরফে নুরু, মো. এনামুল হক বাদশা, মো. বদরুল আলম, মো. সোনাই মিয়া, মিলন মিয়া, নিজাম উদ্দিন ওরফে হৃদয়, মো. মিজানুর রহমান, আকাশ মাতব্বর, সাগর মাতব্বর, সানোয়ার হাসান ও ইমন ওরফে মিলন জমাদ্দার।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পুলিশে ব্যাপক রদবদল হয়। দেশ থেকে পালিয়ে যান তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। তদন্তে ভাটা পড়ে চাঞ্চল্যকর ছিনতাইয়ের ওই ঘটনাও।

তবে ডিএমপিতে রদবদলের পর ফের তদন্তে গতি ফেরে। সর্বশেষ গত ১৯ জানুয়ারি আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করে মিরপুর ডিবি পুলিশ।

আলোচিত ওই ঘটনাটির চার্জশিট দাখিল সম্পর্কে জানতে চাইলে মোট গোয়েন্দা মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলায় মোট জড়িত আসামি ছিল ১৫ জন। তাদের মধ্যে মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

এখনো এই মামলায় অভিযুক্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করা ও বাকি ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা উদ্ধার সম্ভব হয়নি বলেও জানান তিনি।

চার্জশিটে অভিযুক্ত যারা

তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবি সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার ১৩ জনের বাইরে এ মামলায় আরো দুইজনকে চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন মো. মোস্তফা ও মো. জনি মিয়া। তবে এই দুইজন পলাতক রয়েছেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মানি প্ল্যান্ট লিংক লিমিটেডের সাবেক গাড়িচালক সোহেল। তার সঙ্গে টাকা লুটের পরিকল্পনায় ছিলেন আকাশ ও সানোয়ার। অন্য ব্যক্তিরা সরাসরি ছিনতাইয়ে অংশ নেন। ছিনতাইয়ের কবলে পড়া গাড়ির নকল চাবি ছিল ডাকাতদের কাছে। সেই চাবির মাধ্যমে গাড়ির দরজা খোলেন ডাকাতেরা।

কর্মকর্তারা আরো জানান, ডাকাতির ঘটনা ঘটাতে কয়েক স্তরে বিভিন্নজনের সম্পৃক্ততা ছিল। কেউ ছিলেন পরিকল্পনাকারী, কেউ মোবাইল ফোন ও সিম সংগ্রহকারী, কেউ জনবল সংগ্রহকারী। টাকা লুটের পরিকল্পনা নিয়ে ইমন ওরফে মিলনের সঙ্গে আলোচনা করেন আকাশ। তিনি মিলনকে বলেন, হুন্ডির টাকা ধরতে হবে। এজন্য কিছু লোক প্রয়োজন। পরে মিলন তার পূর্বপরিচিত সানোয়ার হোসেনকে বিষয়টি জানান। সোহেলকে জনবল ও সিম সংগ্রহ এবং মোবাইল ফোন কেনার দায়িত্ব দেন তিনি। সানোয়ার আটটি নতুন সিম ও ফোন সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি সুনামগঞ্জ (নিজ জেলা) ও নেত্রকোনা থেকে নয়জনকে সংগ্রহ করেন। তারা প্রত্যেকে ঘটনার দুই দিন আগে ঢাকায় একত্র হন।

টাকা বহনের সময়, নিয়ম অনুযায়ী সিকিউরিটি কোম্পানির কর্মীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না।

পরিকল্পনাকারীরা এই ব্যক্তিদের নতুন কাপড় ও জুতা কিনে দেন। আকাশ ও সোহেল ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা লুটের বিষয়টি গোপন রাখেন মিলন ও সানোয়ারের কাছে। ঘটনার দিন সবাই কুর্মিটোলায় একত্র হন। ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটিতে ওঠার পর মিলন ও সানোয়ার বুঝতে পারেন, বড় কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এরপর পরিকল্পনামাফিক টাকা লুট করা হয়।

জানতে চাইলে মামলার বাদী ও মানি প্ল্যান্ট লিংকের পরিচালক আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ছিনতাই হওয়া সোয়া ১১ কোটির মধ্যে ৮ কোটি টাকা আমরা পেয়েছি। বাকি টাকা পুলিশ এখনো উদ্ধার করতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘টাকা ডাচ-বাংলা ব্যাংকের। আমরা শুধু বাহক হিসেবে সেটি বুথে নিয়ে যাচ্ছিলাম। টাকা বহনের চুক্তি অনুযায়ী প্রায় পুরো টাকা ডাচ-বাংলা ব্যাংক আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে। বরং বাকি টাকার জন্য ব্যাংকের প্রেসারে আছি আমরা। বাকি টাকাও আমরা পরিশোধের চেষ্টা করছি। আমাদের এখন কিস্তি টানতে হচ্ছে।’

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিবি মামলার চার্জশিট দিয়েছে জেনেছি। তবে পলাতক দুই আসামিকে গ্রেপ্তার ও বাকি টাকা উদ্ধারে দাবি জানান তিনি।

জেইউ/জেডএস