সিলেটে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা, দরকার প্রস্তুতি
সিলেটে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত প্রায় ১৮ ঘণ্টায় ওই অঞ্চলে হওয়া ছোট ছোট ৫টির বেশি ভূকম্পন এ শঙ্কা তৈরি করেছে। এজন্য দরকার পূর্বপ্রস্তুতি।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের ভূকম্পন ইউনিটের ইনচার্জ ও ভূকম্পন বিশেষজ্ঞ মো. মমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় ভূমিকম্পন হওয়ার আগে অনেক সময়ে ‘আফটার শক ও বিফোর শক’ হয়ে থাকে।
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, অতীতের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত বড় ভূমিকম্প হওয়ার আগে ছোট ছোট একাধিক ভূকম্পন হয়ে থাকে (বিফোর শক)। আবার এর বিপরীতও হয়ে থাকে। আর বড় ভূমিকম্পন হওয়ার পরে ছোট ছোট ভূমিকম্পন হলে শক্তি ফুরিয়ে যায় (আফটার শক)। তখন আর বড় কোনো ভূকম্পনের দেখা মেলে না।
তিনি বলেন, তবে সিলেট অনেক আগে থেকেই ভূকম্পন এলাকা হিসেবে ঝূঁকিপূর্ণ। সুতরাং আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা দরকার। বিশেষ করে এখানে আবাসস্থল পরিকল্পনা মাফিক গড়ে তুলতে হবে।
আবহাওয়া অধিদফতরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক জহিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টার মধ্যে সিলেটে অন্তত ৫টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এগুলোর দূরত্ব ছিল ঢাকা কেন্দ্রস্থল থেকে ১৯৬ থেকে ২৩৫ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে। তবে স্থানীয়রা বলছেন ৫টির অধিক ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান মনে করেন, ছোট ছোট ভূকম্পন হওয়ার ফলে বড় ভূমিকম্পনের ঝুঁকি কমে গেছে এটা বলার সুযোগ নেই।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় ভূকম্পন হওয়ার আগে পরপর ছোট ছোট অনেক বেশি ভূকম্পন হয়ে থাকে। সিলেটে যে ছোট ছোট ভূকম্পন হয়েছে তার সময় ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে গেছে। এ হিসেবে বড় ভূমিকম্পন হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কমে গেছে। কেননা, যখন ছোট ছোট ভূমিকম্পন অল্প সময়ে অনেক বেশিবার হবে তখন বড় ভূকম্পন হওয়ার শঙ্কা বেশি থাকে।
তিনি জানান, রোববার সকালে যে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে সেটা চায়নার ভূকম্পনেরও হতে পারে। তবে বড় ভূকম্পন হওয়ার আগে কিন্তু ছোট ছোট ভূকম্পন হয়ে থাকে। সুতরাং শঙ্কাটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের ভূতত্ত্ব বিভাগের ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার মনে করেন, বড় ভূকম্পনের শঙ্কা কাটেনি। অতীতের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, গত ৫০০ থেকে ১ হাজার বছর ধরে সিলেট, টেকনাফ, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় অনেক শক্তি জমে আছে। সুতরাং, এখানে বড় ভূকম্পন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কেননা, এই শক্তি কোনো না কোনোভাবে বের হবেই। আজ, কাল অথবা ভবিষ্যতে হোক।
তিনি বলেন, যে শক্তি জমে আছে এসব এলাকায় তাতে ৮ মাত্রার ভূকম্পন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, সেটা কবে হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। হয়তো ছোট ছোট ভূকম্পনের মাধ্যমে সেই শক্তি বের হয়ে আসতে পারে।
এ বিশেষজ্ঞ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ জন্যে আমাদের এখন থেকেই মহরা করা দরকার। প্রতিটি ওয়ার্ডের মানুষ যেন সতর্ক হতে পারেন। মহরার কোনো বিকল্প নাই। যদি ছোট ছোট ভূকম্পন হয়েও সে শক্তি শেষ হয়ে যায় তারপরও আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে। ছোট ছোট ভূকম্পন হলেও যেন মানুষ আতঙ্কিত না হন সেজন্যেও সতর্ক থাকতে হবে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ জানান, পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০-১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার ছোট-বড় ১৩টি খণ্ডে (প্লেটে) বিভক্ত। উত্তপ্ত ও নরম এস্থোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান এ প্লেটগুলো গতিশীল।
প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সরতে থাকে, যেটাকে ‘অ্যাকটিভ ফল্ট’ বা সক্রিয় চ্যুতি বলা হয়। প্লেটের স্থানচ্যুতির সময় জমে থাকা শক্তি বিপুল বেগে বের হয়, তখন সংযোগস্থলে ভূমিকম্প হয়।
বাংলাদেশের উত্তরে ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল হলো পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেটের ডাউকি অঞ্চলে রয়েছে এমন ফল্ট।
আর ‘সাবডাকশন জোন’ সমুদ্র তলদেশের এমন এলাকা যেখানে দুটি টেকটনিক প্লেট মুখোমুখি অবস্থানে থাকে এবং প্লেট দুটো পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এমন অবস্থায় একটি টেকটনিক প্লেট আরেকটি নিচে চলে গেলে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প।
অতীত ইতিহাসের তথ্য তুলে ধরে ভূতত্ত্ববিদ হুমায়ুন জানান, ১৯২২ সালে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল হবিগঞ্জ অঞ্চলে; ১৯১৮ সালেও ৭.৫ মাত্রার হয়েছিল। চার বছরের ব্যবধানে বড় ভূমিকম্পন ছিল শত বছর আগে। এক মাস আগে ডাউকি ফল্টেরই উত্তর প্রান্তে আসাম সীমান্তে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। তার মানে এ ‘ডাউকি ফল্ট খুব সক্রিয়’।
ডাউকি ফল্ট ও টেকনাফ সাবডাকশন জোনে হাজার বছর ধরে যে পরিমাণ শক্তি ক্রমান্বয়ে সঞ্চয় হয়ে আসছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প সংগঠিত করতে পারে। এ শক্তি একবারেও বের হতে পারে; আবার পালাক্রমেও বের হতে পারে। আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
একে/এইচকে