চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার উন্নয়ন বিল, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুতোষিক ও ভবিষ্যৎ তহবিল খাতসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় আটশ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। কিন্তু সেই বকেয়ার বোঝা মাথায় নিয়েই মেয়রের জন্য কোটি টাকার গাড়ি কিনছে সিটি করপোরেশন। 

করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকেই কেনা হচ্ছে এ গাড়ি। ইতোমধ্যে নতুন গাড়ি কেনার জন্য দরপত্রও পড়েছে একটি। র‍্যাংগস মোটরস লিমিটেড এই গাড়ির জন্য দর দিয়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। রোববার বা সোমবার দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গাড়ি কেনার জন্য টেন্ডার হয়েছে, কিন্তু কেনার জন্য অনুমতি দিইনি। আসলে গাড়ি কেনার পক্ষপাতী আমি নই। কিন্তু মেয়রের ব্যবহারের জন্য একটি গাড়িই আছে। এটি ১৫ বছরের পুরনো হওয়ায় কোনো স্থানে যাওয়ার পথে খারাপ হয়ে যায়। 

তিনি বলেন, সেদিন সরাইপাড়া এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বন্ধ হয়ে যায়। পরে আরেকটি গাড়ি নিয়ে যেতে হয়েছে। প্রকৌশল বিভাগ থেকে বলছে, বর্তমান গাড়িটি ঠিক করার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে একটা নতুন গাড়ি কিনলেই হয়। আমি বলছি, ঠিক আছে, দেখি চিন্তা করে। যান্ত্রিক বিভাগ টেন্ডার দিয়ে রেখেছে, এখনও আমি কেনার জন্য বলিনি।

মেয়র বলেন, বর্তমান গাড়িটি ২০০৬ সালে কেনা হয়েছিল। তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী গাড়িটি কিনেছিলেন ১ কোটি ১০ লাখ টাকা দিয়ে। এখন তারা (সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের যান্ত্রিক শাখা) একটা নতুন গাড়ি কেনার জন্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার একটি টেন্ডার করেছে। গাড়ি কেনার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। 

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন খাতে বকেয়া রয়েছে আটশ কোটি টাকার উপরে। গাড়ি কেনার জন্য আমি এত আগ্রহী না। বর্তমান গাড়িটি যদি ঠিক করে চালানো যায় তাহলে চলবে।  আর যদি না চলে তাহলে চিন্তা করব। গাড়ি কেনার চেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে শহরকে গুছিয়ে উন্নয়ন করা।

চলতি মাসের ৪ মে মেয়রের গাড়ি কেনার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের যান্ত্রিক শাখা। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এরপর বৃহস্পতিবার মাত্র একটি কোম্পানি গাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য দরপত্র জমা দেয়।

নতুন গাড়ি কেনার বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সুদীপ বসাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়রের জন্য গাড়ি কেনার অনুমতি মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মেয়র যে গাড়িটি ব্যবহার করছেন, সেটি ১৫ বছর আগের। পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে গাড়িতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মেয়র কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হলেন, কিন্তু গাড়ির সমস্যার কারণে মাঝপথে আটকে গেলেন। একজন মেয়রের গাড়ি ১৫ বছরের পুরনো, বিষয়টি কেমন দেখায় না। এজন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নতুন গাড়ি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তিনি বলেন, এমনিতে মেয়রের জন্য দুটি গাড়ি থাকা উচিত৷ কোনো জায়গায় রিপ্লেসমেন্টের প্রয়োজন হলে যাতে দেওয়া যায়। পুরনো গাড়িও থাকবে। পুরানো গাড়িটি মডিফাই করে দিব। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ফান্ড থেকে এ গাড়ি কেনা হচ্ছে। 

দরপত্র জমা পড়ার বিষয়ে সুদীপ বসাক বলেন, গাড়ি কেনার জন্য মাত্র একটি কোম্পানি দরপত্র দিয়েছে। রবি বা সোমবার দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভায় দরপত্রদাতার কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করা হবে। এরপর কমিটি গাড়ি কেনার কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। র‍্যাংগস মোটরস লিমিটেড এ গাড়ির জন্য দর দিয়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

গত ২৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। ১৫ ফেব্রুয়ারি মেয়রের দায়িত্ব নেন তিনি। সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময় সর্বশেষ ১ কোটি ১০ লাখ টাকায় পাজেরো গাড়ি কেনা হয়েছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরীর পর সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমও এ গাড়ি (চট্ট-মেট্রো ঘ-১১-০৭৩৭) ব্যবহার করতেন। তবে আরেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ব্যবহার করতেন নিজের গাড়ি। অবশ্য বিদায়ী প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম মেয়রের জন্য নির্ধারিত গাড়ি ব্যবহার করতেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের  (সনাক) চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সিটি করপোরেশনের এত টাকা দেনা রেখে নতুন গাড়ি কেনার জন্য উদ্যোগ অপ্রত্যাশিত। এ টাকা দিয়ে সিটি করপোরেশনের দেনা পরিশোধ করা যেত, কাজে লাগানো যেত।

তিনি বলেন, আমরা মনে করেছিলাম,  বর্তমান মেয়র সাধারণ জনতার কাতারের মানুষ। করোনার এই সংকটে অসংখ্য মানুষ বেকার, খেতে পাচ্ছেন না, চিকিৎসার সামগ্রীর ঘাটতি আছে। এ সময়ে ১ কোটি ত্রিশ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি না নিয়ে তিনি যদি ত্রিশ লাখ টাকার গাড়ি নিতেন তাহলে ঠিক হত। আমাদের দেশের জন্য। 

তিনি আরও বলেন, বিলাসিতা না করে দেনা  পরিশোধ করা, অন্যান্য খরচ কমিয়ে আনার দরকার ছিল।
যেখানে এখনও অনেক মানুষ দুবেলা খেতে পারেন না, যেখানে অনেকে এক মাস কাজ করার পর ৫ হাজার টাকা বেতন পান, সেখানে মেয়রের জন্য ১ কোটি ত্রিশ লাখ টাকার গাড়ি কেনা চূড়ান্ত বিলাসিতা। গাড়ি কেনার আগে সিটি করপোরেশনের ভাবা উচিত।

কেএম