কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’এর আওতায় হারভেস্টার মেশিনসহ অন্যান্য ৪০ হাজার কৃষি যন্ত্র বিতরণে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে একযোগে সারা দেশে ৬ জায়গায় এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

বুধবার (৮ জানুয়ারি) দুদকের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরা হলো। 

অভিযান-১

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় কৃষিযন্ত্র বিতরণে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। এনফোর্সমেন্ট টিম অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কার্যালয় সরেজমিনে পরিদর্শন করে। পরিদর্শনকালে টিম হারভেস্টার মেশিন বিতরণে অনিয়ম, প্রকৃত কৃষক নির্ধারণে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয়, কারসাজির মাধ্যমে কৃষকদের কাছে হারভেস্টার মেশিনের দাম বাবদ প্রকৃত দামের চেয়ে ৩ গুণ বেশি অর্থ আদায়, প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ইত্যাদিসহ নানা অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পায়। 

অভিযান-২

কুষ্টিয়া জেলার ৬ উপজেলায় সরকারের ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের ভর্তুকির কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকের কুষ্টিয়া অফিস থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসের আওতাধীন এ প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় অনিয়ম/দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।

পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসের আওতায় উক্ত প্রকল্পে মোট ৮টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন (প্রতিটির মূল্য ৩৮ লাখ টাকা) কৃষকদের মধ্যে বিতরণ দেখানো হয়েছে, যেখানে অধিকাংশ গ্রাহকের আবেদন, প্রত্যয়নপত্র ও সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রে থাকা তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের গরমিল পাওয়া গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ০৮টি পটেটো ডিগার (প্রতিটির মূল্য দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা) বিতরণ দেখানো হয়েছে। একই পরিবারের তিনজনের নামে এই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে, আবার একজন গ্রাহকের আবেদন ফরমে কৃষি কর্মকর্তার মোবাইল নম্বরও দেওয়া হয়েছে। 

এ ছাড়া ক্রয় সংক্রান্ত ফর্মে তথ্যের অমিল রয়েছে মর্মে অভিযানকালে দেখা যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ২৮টি রিপার মেশিন (প্রতিটির মূল্য এক লাখ ৯০ হাজার টাকা) বিতরণ দেখানো হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কিছু গ্রাহকদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানা যায়, তারা রিপার মেশিনের জন্য আবেদন করলেও তাদের কোনো মেশিন প্রদান করা হয়নি। অভিযানে প্রাপ্ত সকল তথ্যাবলি সন্নিবেশ করে কমিশন বরাবর বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। 

অভিযান-৩

বরগুনা জেলার তালতলা ও আমতলী বরগুনা জেলার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প ঘিরে কৃষকদের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন সরবরাহে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পটুয়াখালী থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযান পরিচালনাকালে এনফোর্সমেন্ট টিম সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ থেকে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। এ সময় সরেজমিনে দৈবচয়নের ভিত্তিতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনপ্রাপ্ত উপকারভোগীদের সাথে কথা বলা হয় এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়। 

সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দেখা যায়, কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন প্রাপ্ত ব্যক্তিরা অধিকাংশই বিভিন্ন ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত কিংবা চাকরিজীবী, তারা কেউই কৃষি কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, অধিকাংশেরই কৃষি কার্ড নেই। টিম আরও জানতে পারে, মেশিন বরাদ্দপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই তাদের মেশিন বিক্রি করে দিয়েছেন, যা পুনরায় সংশ্লিষ্ট মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান/কোম্পানি কিনে নিয়েছে। যা পুরোপুরি বিধিবহির্ভূত। এছাড়াও নিকট আত্মীয়দের বরাদ্দ দেখিয়ে কেউ কেউ একাধিক মেশিনের মালিক হয়েছেন মর্মে জানা যায়। মেশিনের গায়ে চেসিস নম্বর এবং ইঞ্জিন নম্বর খোদাই আকারে লেখা থাকার কথা থাকলেও সরেজমিনে দেখা যায়, উক্ত নম্বর স্টিকার দিয়ে লাগানো। মেশিন বিতরণ এবং তদারকির ক্ষেত্রেও নানা অনিয়মের তথ্য পায় দুদক টিম। প্রাপ্ত নানাবিধ অনিয়ম সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন কমিশন বরাবর দাখিল করা হবে।

অভিযান-৪

নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে ময়মনসিংহের দুদক অফিস থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। টিম প্রথমে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও জেলা কৃষি অফিস হতে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। পরে সরেজমিনে উপকারভোগীদের তথ্যাবলি যাচাই করা হয়। যাচাইপূর্বক সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নে একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের নামে ১০টি উক্ত মেশিন বিতরণের তথ্য পাওয়া যায়, যে পরিবারের একজন কর্মকর্তা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। 

এছাড়াও একই মেশিন দুইবার বিতরণ, নিকট আত্মীয়দের নাম দিয়ে একাধিক মেশিন পাওয়া, মেশিন প্রাপ্তির পরপরই বিক্রিসহ নানাবিধ অনিয়মের বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়। 

অভিযান-৫ 

ঢাকার দোহার উপজেলায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প ঘিরে কৃষকদের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন সরবরাহে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে দুদক টিম উপজেলা কৃষি অফিস সরেজমিন পরিদর্শন করে বর্ণিত ধান কাটার মেশিন তথা কম্বাইন্ড হারভেস্টার প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে কি না সে সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র যাচাই করে। রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে এবং প্রাথমিক যাচাইয়ে টিম বিতরণে অনিয়মের বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। 

অভিযান-৬

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন কৃষকদের মাঝে বিতরণে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিলেট হতে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। 

অভিযানকালে উপপরিচালকের দপ্তর হতে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। রেকর্ডপত্র প্রাথমিক যাচাইয়ে দেখা যায়, একই ব্যক্তি একাধিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন পেয়েছেন, আবার একই মোবাইল নম্বর দিয়ে একাধিক ব্যক্তি হারভেস্টার মেশিন নিয়েছেন। এছাড়া এক ব্যক্তির নামে বরাদ্দকৃত হারভেস্টার মেশিন উপজেলা কৃষি অফিসারের যোগসাজশে অন্য ব্যক্তিকে প্রদান করা হয়েছে- এরূপ তথ্য পায় দুদক টিম। সার্বিক বিশ্লেষণে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে বলে টিমের নিকট পরিলক্ষিত হয়। 

আরএম/এমএন