২০ হাজার মানুষের ভাগ্য, তাদের অধিকার, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু কেড়ে না নিয়ে মধুমতি মডেল টাউনে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ চেয়েছেন মধুমতি মডেল টাউন হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দারা। তারা বলছেন, আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হলে ও আন্যায়ভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিলে ২০ হাজার শিশু, নারী, পুরুষ খুব বিপদে পড়ে যাবে।

বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।

নিজেদের সার্বিক বিষয় তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে মধুমতি মডেল টাউন হাউজিং সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুজাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঢাকা-আরিচা হাইওয়ের পাশেই ২০০১ সালে মধুমতি মডেল টাউন নামক আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠে। আবাসন এলাকাটিতে স্থানীয় জনসাধারণ ধান ও পাট চাষ করতেন। কেউবা জমির মাটি বিক্রি করে বেশি আয় করতেন। ফলে স্থানে স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়। মধুমতির উদ্যোক্তা মেট্রো মেকার্রস অ্যান্ড ডেভলেপার্স লিমিটেড সেই সময় বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম ও শেষ পাতায় বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতেও সমভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো। প্রকল্প এলাকার হাইওয়ের পাশেই স্থাপন করা হয় বিশাল বিশাল বিলবোর্ড, ব্যানার, প্রচার করা হয় লিফলেট। রাতারাতি নয়, দীর্ঘ সময় নিয়ে মেট্রো মেকার্স জমি ভরাট করে আবাসনটি গড়ে তোলে। সে সময় কোনো মিডিয়া, সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা প্রকল্প স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করেনি।

তিনি বলেন, এছাড়া জমির সিএস, আরএস, এসএ খতিয়ানে দেখা গেছে যে, জমির প্রকৃতি হলো-নাল, জলাশয় নয়। এমনি পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে মধুমতিতে জমি ক্রয় করি। যথারীতি সরকারের সাব রেজিস্ট্রার নির্বিঘ্নে জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। এসিল্যান্ড জমি খারিজ করেন ও ভূমি অফিস ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণ করেন। আমাদের প্রশ্ন এখানে প্লট ক্রয়কারী হিসেবে আমাদের অপরাধ কোথায়? অতঃপর ডেভেলপার কোম্পানি রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ নির্মাণ করেন ও বৈদ্যুতিক পোল বসান। পল্লি বিদ্যুৎ- বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করেন। বর্তমানে পল্লি বিদ্যুৎ এ আবাসন থেকে প্রতি মাসে ১৮-২০ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল আদায় করেন।

সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুজাউদ্দিন আহমেদ বলেন, হঠাৎ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অশুভ দৃষ্টি পড়ে মধুমতি মডেল টাউনের প্রতি। তিনি প্রকল্পটিকে বন্যা প্রবাহ এলাকা উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। হাইকোর্ট আমাদের পক্ষে রায় দিয়ে মধুমতি মডেল টাউনের মালিক মেট্রোমেকার্সকে রাজউকের অনুমোদন নিতে বলে। সেখানে বেলা ক্ষ্যান্ত না হয়ে আপিলেট ডিভিশনে আপিল করেন এবং সেখানে প্রভাব খাটিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের আজ্ঞাবহ বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে বেলার পক্ষে একটি রায় করান। সেই রায়েও প্লট মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প এলাকায় মালিক কর্ত্রীপক্ষ মেট্রোমেকার্স যদি ৬ মাসের মধ্যে মাটি সরিয়ে না নেয় তাহলে রাজউক উক্ত মাটি সরিয়ে নেয়ার আদেশ দিয়েছে এবং মেট্রোমেকার্স থেকে মাটি সরানোর খরজ আদায় করতে বলেছে এবং সেখানে কোনো ধরনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। 

একই রায়ে প্লট মালিকদের রেজিস্ট্রেশন ব্যয়সহ জমাকৃত অর্থের দ্বিগুণ টাকা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। অথচ একযুগ অতিবাহিত হলেও অদ্যাবধি ক্ষতিপূরণের একটি টাকাও পরিশোধ না করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উপদেষ্টা হয়ে তার প্রভাব বিস্তার করে রাজউককে দিয়ে আমাদেরকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা মনে করি এই রায়ের ক্ষেত্রেও বৈষম্য হয়েছে। আমাদের একটাই দাবি এই বৈষম্য বিরোধী রায় পরিবর্তন করে আমাদের বসতভিটা রক্ষা করে আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই রক্ষা করা হোক।

সোসাইটির পক্ষ থেকে বলা হয়, মধুমতি মডেল টাউনের পূর্বপাশে ৫০০ বিঘা জমিতে বিদ্যুতের পাওয়ার প্লান্ট, পশ্চিমে বেসরকারি মালিকানাধীন যমুনা ন্যাচারাল পার্ক (প্রায় ৫০ একর), প্রকল্পের সুম্মুখভাগে এক হাজার একর জমিতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড় রয়েছে। সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প তৈরির জন্য একটি চাইনিজ প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও মেট্রোরেলের ডিপো অবস্থিত। এছাড়াও আরও বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে এই এলাকায়। এ বিষয়ে বেলা বা অন্য কারও কোন অভিযোগ নেই। শুধু মধুমতি মডেল টাউনের দিকে তাদের যত আক্রোশ ও প্রতিহিংসা। অথচ এই প্রকল্পের অনুমোদন এর জন্য সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ৯টি ছাড়পত্রের মধ্যে ৮টি ছাড়পত্র গ্রহণ করা হয়েছে। ২০ হাজার মানুষের বসবাস এখানে। প্রকল্পে ১০ লাখের বেশি গাছ রয়েছে। একটি গাছ কাটলে বেলা আন্দোলন করে অথচ এই প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে ১০ লাখের বেশি গাছ কাটা যাবে। এটা কি পরিবেশের ওপর মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে না? ২০ হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা কি মানবাধিকার বিরোধী নয়? অন্যান্য স্থাপনা রেখে কেবল মাত্র মধুমতি উচ্ছেদ চরম বৈষম্যের উদাহরণ নয় কি? ১০ লাখ এর বেশী গাছ ধ্বংস করা কি ধরনের পরিবেশ রক্ষা?

সুজাউদ্দিন আহমেদ বলেন, আশিয়ান সিটি, পূর্বাচল, জলসিড়ি, বসুন্ধরা, ঝিলমিল, আফতাব নগর, বনশ্রী, ঢাকা ও চন্দ্রিমা উদ্যান, বসিলা সিটি, সবই নিচু এলাকা ভরাট করে গড়ে উঠেছে। তাই আমরা মনে করি বেলা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের কোন মহলের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে বিতর্কিত সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত বিচার ব্যবস্থার দ্বারা আমরা বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আমরা এর প্রতিকার চাই। ইতোমধ্যে মেট্রো মেকার্সের রায়ের মডিফিকেশন চেয়ে চেম্বার জজ আদালতে একটি আবেদন করেছে। চেম্বার জজ আগামী ২৩ জানুয়ারি ফুল কোর্টে শুনানির দিন ধার্য করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- মধুমতি মডেল টাউন হাউজিং সোসাইটির সভাপতি শেখ আব্দুল্লাহ, সহ সভাপতি  সৈয়দ মোশাররফ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আজম খান মুন্না, দপ্তর সম্পাদক জিয়া হায়দার খান সহ সোসাইটির সদস্য বাসিন্দারা।

প্রসঙ্গত, উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে সাভারের বিলামালিয়া ও বেইলারপুর মৌজায় মেট্রো মেকার্স অ্যান্ড ডেভেলপার্স নির্মিত মধুমতী মডেল টাউন সম্পর্কে করণীয় বিষয়ক গত ১৮ ডিসেম্বর আন্তঃসংস্থা সমন্বয় সভা করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

রাজউকের পক্ষ থেকে জনানো হয়, উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত কর্মসূচি ও করণীয় সম্পর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উচ্ছেদ কার্যক্রমে জড়িত বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বেলার সাথে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমন্বয় সভায় উপস্থিত বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের মধ্যে মতবিনিময়ের পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, রাজউক কর্তৃক দুই সপ্তাহের মধ্যে মধুমতী মডেল টাউন প্রকল্পটির উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

এএসএস/এমএ