জমি অন্যের, দখল আউয়ালের
রাজধানীর পল্লবী থানার মিরপুর-১২ এলাকার বুড়িরটেক, টেকেরবাড়িসহ বাউনিয়া মৌজায় অধিগ্রহণ করা জমিতে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ গড়ছে ‘স্বপ্ননগর’ নামের আবাসিক প্রকল্প। এ প্রকল্পের পাশেই প্রভাব খাটিয়ে হ্যাভেলি প্রপার্টিজ কোম্পানির অধীনে সাবেক এমপি এম এ আউয়াল গড়েন ‘আলী নগর আবাসিক প্রকল্প’। এ প্রকল্পে অন্যের কাছ থেকে দখল করা ও রাজউকের অধিগ্রহণ করা জমির বাইরে নিজের জমি নেই তার।
জমি দখল করাই যেন লক্ষ্মীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়ালের নেশা। এজন্য মূল হাতিয়ার হিসেবে তিনি বেছে নেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, হামলা ও মামলা। ওই এলাকায় জমি দখল নিয়ে বিরোধে এখন পর্যন্ত লাশ পড়েছে সাতটি। সর্বশেষ প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় স্থানীয় জমির মালিক সাহিনুদ্দীনকে। আউয়ালের দখলবাজির বলি তিনি— বলছেন ভুক্তভোগী বাসিন্দারা।
বিজ্ঞাপন
তারা বলছেন, আউয়ালের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে হলেও রাজত্ব কায়েম করেছেন রাজধানীর পল্লবীতে। মিরপুরের সিরামিকস এলাকার পূর্ব পাশের সরকারি, খাস ও অন্যের জমি জোরপূর্বক দখলে নিয়ে হাউজিং প্রজেক্ট গড়েন। প্রথমে তিনি জমি কেনার প্রস্তাব দিতেন। প্রস্তাবে সাড়া না দিলে হামলা, তারপর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করতেন। তাতেও কাজ না হলে খুন করতেও দ্বিধা করতেন না আউয়াল। এসব অপকর্মের জন্য তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন ক্যাডার বাহিনী। এসব বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
স্থানীয় লোকজন এবং পল্লবী থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পল্লবীর বাসিন্দা জয়নুদ্দিনের দুই ছেলে সাহিনুদ্দীন ও মাইনুদ্দীন। বংশগত এবং পারিবারিকভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রায় ১২ একর জমি। সেই জমি দখল পেতে আউয়ালের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত সাহিনুদ্দীনের পরিবারের।
নিহত সাহিনুদ্দীনের পরিবারের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরে হ্যাভেলি কোম্পানির সঙ্গে তাদের বিরোধ চলছিল। একাধিকবার মামলা-হামলা চালিয়েও সাহিনুদ্দীনকে বাগে আনতে না পেরে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়ায় আউয়ালের লোকজন। তবে হ্যাভেলির সঙ্গে সমঝোতা করলেও জমির দখল না ছাড়ায় খুন করা হয় সাহিনুদ্দীনকে।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক সময় মমিন বক্স ছিলেন মিরপুর এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক। রাজধানীর পল্লবীর ৯ নম্বর ও ১২ নম্বরে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতার অভিযোগে তার নামে ছিল ১৮ মামলা। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই মোহাম্মদপুর থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় পল্লবীর ১২ নম্বরের টেকেরবাড়ির সামাদ বক্সের ছেলে মমিন বক্সকে। চার দিন পর কালশী ব্রিজ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়।
২০১৫ সালের ১৪ মে বুড়িরটেকে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় বঙ্গবন্ধু কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র চঞ্চল খুন হন। ওই হত্যা মামলায় মমিন বক্স ছিলেন প্রধান আসামি। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে এ দুই খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আমান। আমানের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণসহ ১৪টি মামলা আছে। মমিন বক্সের পর খুন হন মাছ ব্যবসায়ী পাগলা খোকন ও ডি-ব্লকের স্থানীয় মিন্টু। এরপর কালাপানির মুসা, ডিওএইচএস সড়কে খুন হন পাকিস্তানি মোহাম্মদ আলী।
২০০৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিরামিকের পেছনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় র্যাব-পুলিশের সোর্স আব্বাসকে। আব্বাস হত্যার পর আলোচনায় আসেন সাবেক এমপি আউয়াল। ওই সময় হ্যাভেলি প্রপার্টিজ গড়ে বুড়িরটেকে শুরু করেন দখলবাজি।
আউয়ালের টার্গেট কেন সাহিনুদ্দীন
পল্লবীর জয়নুদ্দিনের ছেলে মাইনুদ্দীন ও সাহিনুদ্দীন। হ্যাভেলির মালিক সাবেক এমপি আউয়ালের সঙ্গে মাইনুদ্দীন বিরোধে জড়ালেও সমঝোতায় চলছিলেন সাহিনুদ্দীন। জয়নুদ্দীন পরিবারের অধীনে ছিল প্রায় ১২ একর জমি। ওই জমির কিছু অংশ সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। পাশেই আউয়ালের গড়া আলীনগর প্রকল্পে জমি দিতেও রাজি ছিলেন সাহিনুদ্দীন।
তাহলে কেন খুন হতে হলো সাহিনুদ্দীনকে— জানতে চাইলে মা আকলিমা বেগম শনিবার (২২ মে) দুপুরে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিরামিকের পেছনে বুড়িরটেকে তাদের ১২ একর জমি অবৈধভাবে দখলে নিতে চেয়েছিল হ্যাভেলি কোম্পানি। এটা নিয়ে জমি রক্ষায় তার স্বামী জয়নুদ্দীন জজ কোর্টে মামলা করেন। সেখানে আউয়াল সমঝোতা করতে গেলে বাধা দেন ছেলে মাইনুদ্দীন। সেখানে পারিবারিক চাপে এবং আউয়ালের পানির দরে জমি নেওয়ার কৌশল টের পেয়ে বাধ সাধেন সাহিনুদ্দীনও। এতে ক্ষুব্ধ হন আউয়াল।
এরই জের ধরে গত বছরের নভেম্বরে সিরামিক ২ নম্বর গেটের সামনে সাহিনুদ্দীনকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সুস্থ হওয়ার পর সাহিনুদ্দীনের নামে দেওয়া হয় আধা ডজন মামলা। খুনের আগের সপ্তাহে জামিনে বেরিয়ে আসেন সাহিনুদ্দীন। দ্বিতীয় দফায় গত ১৬ মে বিকেলে পল্লবী থানার ডি ব্লকের একটি গ্যারেজে নিয়ে নিজের পাঁচ বছরের শিশুসন্তান মাশরাফির সামনেই নৃশংসভাবে খুন করা হয় সাহিনুদ্দীনকে।
চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার পর র্যাব-পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি আউয়াল। হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে সাহিনুদ্দীনকে কুপিয়ে হত্যায় সরাসরি জড়িত মানিক র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
আউয়ালের দখলবাজিতে বাদ যাননি সেনা কর্মকর্তাও
সম্প্রতি মোস্তফা কামাল নামে সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার জমি দখলের চেষ্টা করে আউয়াল বাহিনী। জমিতে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় তারা। ওই ঘটনায় গত ৭ মে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন মেজর (অব.) মোস্তফা কামাল।
সাহিনুদ্দীন খুনের পরও আউয়ালের সহযোগীদের হুমকিতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রতিবেশী সাবু। তিনি বলেন, বুড়িরটেকের প্রবীণ বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীর ১০ ছেলে ও দুই মেয়ের জমিতে আউয়ালের আলীনগর কোম্পানি ও হ্যাভেলি প্রপার্টিজ অবস্থিত। জমি দখলে নেওয়ার পর মোহাম্মদ আলীদের তাড়িয়ে দেন আউয়াল। পাশের প্রায় ১২ একর জমির মালিক জয়নুদ্দীনের ছেলে মাইনুদ্দীন ও সাহিনুদ্দীনের পরিবারের বসবাস। তাদের জমি দখল কিংবা অধিকারে নিতে আউয়াল খুন করেন সাহিনুদ্দীনকে।
বাবার খুনিদের ফাঁসি চায় ছোট্ট মাশরাফি
গত ১৬ মে বিকেলে শিশুসন্তান মাশরাফিকে মোটরসাইকেলে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন সাহিনুদ্দীন। মাশরাফির সামনেই এলোপাতাড়ি কুপিয়ে খুন করা হয় সাহিনুদ্দীনকে।
শনিবার দুপুরে বুড়িরটেকে নিজ বাসায় ছোট্ট মাশরাফি ঢাকা পোস্টকে বলে, প্রথমে মনির ও মানিক আব্বুকে কুপিয়েছে। পরে দেখি সুমন, হাসান ইকবালসহ আরও কয়েকজন। আব্বু তো এখন কবরে। আমি তো আর ওদের কোপাতে পারব না। ওদের যেন ফাঁসি হয়।
কী বলছে পুলিশ-র্যাব
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনের এডিসি আহসান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাহিনুদ্দীনসহ এর আগে আরও চারটি খুনের নেপথ্যের কারণ আমরা জানতে পেরেছি। সবগুলোই জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ। আমরা আপাতত সাহিনুদ্দীন খুনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছি। তাকে হত্যার সঙ্গে আউয়ালসহ গ্রেফতাররা ছাড়া আর কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাহিনুদ্দীন খুনের নেপথ্যে ছিল আউয়ালের জমির লোভ। সাহিনুদ্দীনের খুনে তারই চাচাত ভাইয়েরও যোগসাজশ রয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে ঘটনার চাঞ্চল্যতায় তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সাবেক এমপি আউয়ালকে গ্রেফতার করে থানা পুলিশে সোপর্দ করেছি।
তিনি বলেন, আউয়াল যে শুধু সাহিনুদ্দীন পরিবারের জমিই দখলে নিতে চেয়েছিলেন তা নয়, আরও অনেক ভুক্তভোগী আসছেন। তাদেরকে আইনি পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিচ্ছি।
জেইউ/আরএইচ/এমএআর