উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন। উপসচিব/যুগ্মসচিব/অতিরিক্ত সচিব/সচিব পদে শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন হওয়া উচিৎ বলেও মনে করে সংগঠনটি।

বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আপত্তির কথা জানায় সংগঠনটি।

এর আগে মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সচিবালয় বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এ সুপারিশের কথা তুলে ধরেন। 

কমিশন প্রধানের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন।  

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় কমিশন প্রধানের দেওয়া বক্তব্যের প্রতি বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। কমিশন প্রধান সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য বিদ্যমান ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করার সুপারিশের বিষয় অবহিত করেছেন। একটি জনমুখী, দক্ষ, নিরপেক্ষ এবং যুগোপযোগী জনপ্রশাসন বিনির্মাণে প্রজাতন্ত্রের সর্বনিম্নতম বেতন গ্রেডের কর্মচারি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বেতন গ্রেডের কর্মকর্তা পর্যন্ত বিবেচনা করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে সমন্বিত সুপারিশ প্রণয়ন করাই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া আবশ্যক বলে এসোসিয়েশন মনে করে। 

উপসচিব পদোন্নতি প্রত্যাশী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতামত, জরিপ, সমীক্ষা সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি বলে জানা যায়। ফলে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে মাঠ প্রশাসনসহ সকল স্তরে কর্মরত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন কমিশন প্রধানের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

এতে বলা হয়, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সার্ভিসের কর্মকর্তারা যখন অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনামতে আইন-শৃংখলাসহ স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, সেখানে এ ধরনের একটি বক্তব্য আন্ত:সার্ভিস দ্বন্দ্বকে উসকে দিতে পারে এবং সংস্কার উদ্যোগসহ জনপ্রশাসনকে দুর্বল করে দিতে পারে বলে এসোসিয়েশন আশঙ্কা ব্যক্ত করছে। কমিশনের লিখিত রিপোর্ট সরকারের কাছে দাখিলের আগেই আকস্মিকভাবে এ ধরনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হলো এবং তা কোনো মহলের ইন্ধনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমকে অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন বলছে, উপমহাদেশে সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে সব সময়েই প্রশাসন ক্যাডার/সার্ভিসের লোকেরাই উপ-সচিব/যুগ্মসচিব/অতিরিক্ত সচিব/সচিব পদে কাজ করে আসছেন। কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল মানুষকে এই বলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন যে, এই পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার প্রিভিলিজ হিসেবে পান যেটি রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতার প্রতিফলন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাস বলে, পৃথিবীতে সব সময়ে সব স্থানে রাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বর্তমান প্রশাসন ক্যাডারের অনুরূপ একদল মানুষ নিয়োজিত ছিলো। রাষ্ট্র যাতে জনতার স্বার্থ সংরক্ষণ করে সেই উদ্দেশ্য ম্যাক্স ওয়েবার ও উড্রো উইলসন মেধাভিত্তিক, রাজনীতিবিদ থেকে আলাদা, আইন-কানুনকে কঠোরভাবে অনুসরণ করা একদল মানুষের সমন্বয়ে আমলাতন্ত্রের ধারণার প্রচলন করেন। উপমহাদেশে আইসিএস, পাকিস্তান আমলে সিএসপি ও বাংলাদেশের বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার মেধাভিত্তিক সেই আমলাতন্ত্রের মূল ধারা। এ ধারার ব্যত্যয় ঘটানোর অপচেষ্টা না করে দক্ষ আমলাতন্ত্র তৈরিতে সংস্কারের সুপারিশ বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন সাদরে সমর্থন করে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমরা অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে রাষ্ট্রের কল্যাণের স্বার্থে মনে করি, চারটি কারণে উপসচিব/যুগ্মসচিব/অতিরিক্ত সচিব/সচিব পদে শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন হওয়া উচিৎ। 

এতে বলা হয়, আমরা জুলাই-বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম একটি যুগোপযোগী, নিরপেক্ষ এবং প্রফেশনাল সিভিল প্রশাসন বিনির্মাণে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারকে পৃথক করে পূর্বের ন্যায় সকল পদগুলো অন্তর্ভুক্ত করে 'বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস' প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই। একইসঙ্গে, প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য ক্যাডার/নন-ক্যাডার সকল সার্ভিসকে স্ব- স্ব কাজের ধরণ বিবেচনা করে স্বীয় সার্ভিসে পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধিসহ যথাযথ ক্যারিয়ার প্লানিং এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ/বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অধিকতর বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে যুগোপযোগী কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানাই।

প্রকৃতপক্ষে জুলাই-বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম জনপ্রশাসন বিনির্মাণে নিছক কিছু বিধি-বিধানের পরিবর্তন বা সংশোধন যথেষ্ট নয় বরং এমন একটি জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন বিনির্মাণ করতে হবে, যা জনগণের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষা, জনকল্যাণ, সুশাসন এবং নাগরিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করবে। 

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন আরও বলছে, জনপ্রশাসন সংস্কার বর্তমান সরকারের বিবেচনাধীন কার্যক্রমগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে বিপুল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। তাই তড়িঘড়ি করে প্রতিবেদন দাখিলের পরিবর্তে পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে জনমুখী, সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য কমিশনের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হলো। 

এসএইচআর/এমএসএ