পার্বত্য চুক্তিতে বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক ধারা সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে। সোমবার (২ ডিসেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ দাবি জানানো হয়।

বৈঠকে উপস্থিত বক্তারা বলেন, প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎকালীন শান্তি বাহিনী রক্তের হোলি খেলায় মেতে ছিল। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি হলে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনার অবসান ঘটবে বলে প্রত্যাশা করেছিলাম। সেই শান্তি চুক্তির ২৭ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। কিন্তু এখনো শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে। উল্টো এখন পাঁচটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি হয়েছে।   গত দুই দশকে এই পাঁচটি গ্রুপের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।

তারা বলেন, পাহাড়ের বাসিন্দারা যদি একটা কলার ছড়াও বাজারে বিক্রি করতে যায়, তাহলে চাঁদা দিতে হয়। এই পাঁচ সশস্ত্র গ্রুপকে নির্ধারিত হারে চাঁদা দেওয়া ছাড়া কোনো পাহাড়ি ও বাঙালির রক্ষা নেই।

বক্তারা বলেন, শান্তি চুক্তির পরও পার্বত্য অঞ্চলে কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন– জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এম এন লারমা), ইউপিডিএফ (প্রসিত), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও কেএনএফ পার্বত্য অঞ্চলে চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। তাদের কাছে পাহাড়ি-বাঙালিরা জিম্মি। সশস্ত্র সংগঠনগুলোর অবসান যতদিন পর্যন্ত না হবে ততদিন পাহাড়ে শান্তি আসবে না। তাই তাদের নির্মূল করা জরুরি।

অন্যদিকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের শর্তানুযায়ী এখন পর্যন্ত একটি ব্রিগেডসহ ২৩৮টি বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। শান্তি চুক্তির ৩৪ ধারা অনুযায়ী ইতোমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার ৩০টি বিভাগ, রাঙামাটি জেলার ৩০টি বিভাগ এবং বান্দরবান জেলার ২৮টি বিভাগ হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘ খণ্ডের ১ ধারা অনুযায়ী ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতীয় শরণার্থী পরিবারকে ইতোমধ্যে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে। ২০ বছর পূর্বে যারা চাকরি ত্যাগ করেছিল তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। প্রত্যবসিত শরণার্থীদের ভূমি সমস্যার সমাধান কল্পে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে।

গোলটেবিল বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ, ঢাকা মহানগর সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা আল ইজাজ অভিযোগ করে বলেন, সন্তু লারমার জেএসএসসহ কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ নিজেদের সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে চাঁদাবাজির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। সেখানে চাঁদাবাজি একটা সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। ডিম, মুরগি, ফল, সবজি বিক্রি থেকে শুরু করে সব ধরনের কৃষিকাজ, ব্যবসা, অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সব ধরনের পেশার ওপর নির্ধারিত হারে চাঁদা ধার্য করে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। চাঁদা না দিলে তারা হত্যা, গুম, অপহরণ, নির্যাতন চালায়। শান্তি চুক্তি করা হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্য পোষণ করার জন্য। অথচ জেএসএস সভাপতি প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা ভোগ করার পরও একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মতো জাতীয় দিবসগুলো পালন করেন না। তিনি এখনো বাংলাদেশের ভোটার হননি বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, শান্তি চুক্তিতে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের মূল স্রোতধারা থেকে সর্বক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অথচ এর সুযোগ নিয়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো ও তার সমর্থকেরা বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, উন্নয়নের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ও ঘৃণাব্যঞ্জক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। তারা দেশিবিদেশি ইন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। শান্তি চুক্তিতে তারা ‘উপজাতি’ হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতি দিলেও এখন নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে দাবি করছে। শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পরপরই সন্তু লারমার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, শান্তি চুক্তির একটি অলিখিত রূপ ছিল এবং সেই অলিখিত শান্তি চুক্তিও বাস্তবায়ন করতে হবে। তাদের সেই দাবি মেনে ভূমি কমিশন আইন-২০০১ এর অধিকতর সংশোধনী ২০১৬ জাতীয় সংসদের পাস করা হয়েছে।

মোস্তফা আল ইজাজ বলেন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্বেই বলা হয়েছে, শান্তি চুক্তি হচ্ছে পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের একটি আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু সেই শান্তি চুক্তিতেই এমন কিছু ধারা সংযোজিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত বহু আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একইসঙ্গে তা বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক। এরই মধ্যে শান্তি চুক্তির বিভিন্ন ধারা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে। এ রিটের রায়ে উচ্চ আদালত শান্তি চুক্তির অনেকগুলো ধারা অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানও ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি সংশোধন হচ্ছে না। কোনো চুক্তি বা আইন তো আর সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে পারে না। কেননা, আইন ও চুক্তি হয়ে থাকে সংবিধানের আওতায়। শান্তি চুক্তিও সেভাবে বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায়ই হয়েছে। সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক ধারাগুলো সংশোধনপূর্বক চুক্তি পুনঃমূল্যায়ন করার দাবি জানাচ্ছি।

এসময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার অপসারণ, পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যাহার করা নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প পুনঃস্থাপনের দাবিও জানান।

গোলটেবিল আলোচনায় নাগরিক পরিষদ ঢাকা মহানগরের সভাপতি আব্দুল হামিদ রানা সভাপতিত্ব করেন। এসময় প্রধান অতিথি হিসেবে এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান মনির, সুপ্রিম কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আলম খানসহ অন্যরা বক্তব্য দেন।

আরএইচটি/এসএসএইচ